একাদশ সংসদ নির্বাচনের মাত্র এক সপ্তাহ আগে প্রায় অর্ধশত আসনে প্রার্থিতা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ে বৈধতা পেলেও উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় বিএনপির ১৭ জনের প্রার্থিতা আটকে গেছে। এ ছাড়াও জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে জামায়াতের ২৫ প্রার্থীর প্রার্থিতা নিয়েও। আগামী সোমবার এ ২৫ প্রার্থীর বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে সংবিধান এবং নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পর মনোনয়ন বাতিল আরপিও এবং সংবিধান লঙ্ঘন। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময় শেষ হওয়ার পর মনোনয়ন বাতিল করা উচিত নয়। সংুব্ধ কারও কোনো অভিযোগ থাকলে ভোটের পর নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে সেই অভিযোগের সুরাহা হতে পারে।
গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের ১৪(৫) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো প্রার্থী অথবা ব্যাংক যদি রিটার্নিং অফিসারের সিদ্ধান্তে সংুব্ধ হয় তবে সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কমিশনে আপিল করতে পারবেন। আপিল ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।
আর সংবিধানের ১২৫ (খ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সংসদ কর্তৃক প্রণীত কোন আইনের দ্বারা বা অধীন বিধান-অনুযায়ী কর্তৃপরে নিকট এবং অনুরূপভাবে নির্ধারিত প্রণালীতে নির্বাচনী দরখাস্ত ব্যতীত রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন বা সংসদের কোন নির্বাচন সম্পর্কে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’
জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের সাবেক রেজিস্ট্রার জেনারেল ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ইকতেদার আহমদ এ প্রসঙ্গে বলেন, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার শেষ হয়ে গেলে আর কোনো প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল করার সুযোগ নেই। প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে তার জন্য নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল আছে। সংবিধান এবং আরপিও সেটাই বলে। সেখানে সংুব্ধরা সুরাহা পেতে পারেন। আদালতের কাজ হলো মানুষের অধিকার সংরক্ষণ করা। নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া মানুষের অধিকার। আদালত মনোনয়ন বাতিল করলে অধিকার থাকল কোথায়?
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচনে আদালত যেভাবে হস্তক্ষেপ করছে এটা আমাদের দুর্ভাগ্য। সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা করার দায়িত্ব আদালতের। এখন আদালত প্রতীকও বরাদ্দ দিচ্ছেন। নির্বাচন বিষয়ে দুইটি বিষয়ের বাইরে আদালতের হস্তক্ষেপ করা ভালো দেখায় না বলে মনে করেন তিনি। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালের ৫ জুন আপিল বিভাগের ফুল বেঞ্চের দেয়া রায়ে বলা হয়েছিল, কোনো নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পরে রিটের মাধ্যমে দু’টি ব্যতিক্রম বাদে আর কোনো বিরোধের ফয়সালা হবে না, যা হওয়ার নির্বাচনের পরে হবে। আর তাও রিটে নয় নির্বাচনী বিরোধ হিসেবে সুরাহা হবে ট্রাইব্যুনালে।
প্রধান বিচারপতি এ টি এম আফজাল, বিচারপতি লতিফুর রহমান, বিচারপতি মোহাম্মদ আব্দুর রউফ, বিচারপতি বিমলেন্দু বিকাশ রায় চৌধুরী এবং বিচারপতি মোস্তফা কামালের সমন্বয়ে গঠিত আপিল বিভাগের ফুল বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে ওই সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন।
আপিল বিভাগ সর্বসম্মতভাবে ৪১ ডিএলআরে বর্ণিত এ এফ এম শাহ আলম বনাম মুজিবুল হক এবং অন্যান্য মামলার বরাত দিয়ে বলেছিলেন, এই আদালত অর্থাৎ বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় এই নীতি নিশ্চিত করেছেন যে হাইকোর্ট বিভাগের অধীনে সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের আওতায় কোনো একটি নির্বাচন প্রক্রিয়া চলাকালে কোনো পদপেকে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। শুধু দু’টি ব্যতিক্রম ছাড়া। এর একটি হচ্ছে, দেখাতে হবে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় রিটার্নিং অফিসার বা নির্বাচন কমিশন যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের যথাযথ এখতিয়ার ছিল না। একে বলে কোরাম নন জুডিস। দেখাতে হবে, রিটার্নিং অফিসার বা ইসির নিয়োগ বৈধ ছিল না। দ্বিতীয়ত যেটা দেখাতে হবে, সেটা হলো মেলিস ইন ল অর্থাৎ যে আইনের আওতায় সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে, সে আইনটি বিদ্বেষপূর্ণভাবে প্রণীত হয়েছিল।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কর্মকাণ্ডে তাদের প্রতি আস্থা দিন দিন কমছে। ইসির উচিত অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়া। ইতোমধ্যে বিএনপির ১৭ জন প্রার্থীর নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এরপর যদি জামায়াতের আরো ২৫ জনের প্রার্থিতা বাতিল হয় তাহলে প্রায় অর্ধশত আসনে প্রতিযোগিতা ছাড়া প্রতিপক্ষের প্রার্থী বিজয়ী হবে।
জামায়াতের ২৫ জনের প্রার্থিতার বিষয়ে তিনি বলেন, জামায়াত এই মুহূর্তে নিবন্ধনহীন একটি দল। এই নির্বাচনে নিবন্ধনহীন অনেক দল নির্বাচন করছে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে। তাহলে জামায়াত কেন পারবে না প্রশ্ন রাখেন তিনি। ইসি কর্মকর্তারা জানান, আদালতের আদেশে প্রায় অর্ধশত আসনে প্রার্থিতা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। এসব কারণে নির্বাচন কমিশন এখনো এসব আসনের প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করতে পারেনি। এ জন্য নির্বাচন কমিশন ব্যালট পেপার ছাপানো নিয়ে বিপাকে পড়েছে। এ দিকে আদালতের রায়ে যেসব আসনে বিএনপির প্রার্থীশূন্য হয়েছে, ওই আসনগুলোতে বিকল্প প্রার্থী দেয়া বা পুনঃতফসিল ঘোষণার দাবি জানিয়েছে দলটি।