স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, গত তিন মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন করোনা পরীক্ষা হয়েছে গত ২৪ ঘণ্টায়, মাত্র তিন হাজার ৬৮৪টি। নমুনা সংগ্রহ হয়েছে তারও কম, তিন হাজার ২১৩টি। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে করোনায় শনাক্ত হয়েছেন ৮৮৬ জন।
সর্বশেষ গত ১০ মে ৮৮৭ জন পজিটিভ শনাক্ত হয়েছিলেন। এরপর এই সংখ্যা আর নামেনি। সর্বশেষ গত ২৩ এপ্রিল নমুনা সংগ্রহ ছিল তিন হাজার ৪১৬। এরপর এই সংখ্যা আর এর নিচে নামেনি। ফলে তিন মাসেরও বেশি সময়ের মধ্যে নমুনা পরীক্ষার হারও এটাই সবচেয়ে কম। গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার ২৪ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ।
সরকারিভাবে করোনা পরীক্ষার জন্য ফি নির্ধারণ, দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যা, টেস্ট করতে ভোগান্তি, টেস্টের রিপোর্ট পেতে দেরিসহ নানা কারণে দেশে করোনার পরীক্ষা কমেছে, কমেছে শনাক্ত। সাধারণত, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার দুই সপ্তাহের ভেতরে লক্ষণ-উপসর্গ প্রকাশ পায়। আর ঈদের সময়ে ঢাকা থেকে মানুষের গ্রামে যাওয়া, স্বাস্থ্যবিধি না মেনে পশুর হাট যাওয়া, স্বাস্থ্যবিধি না মেনে কোরবানিও দিয়েছে মানুষ। যার কারণে মধ্য আগস্টে করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় গত আট মার্চ, তার দুই মাসের মাথায় দেশের ৬৪ জেলায় সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর হিসাব থেকে দেখা যায়, শুরু থেকেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেশি ছিল রাজধানী ঢাকাতে, তবে ধীরে ধীরে সেটা ছড়িয়ে পড়েছে পুরো দেশে। তবে মূলত গত ২৫ মে ঈদুল ফিতরের পর ঢাকা থেকে ঢাকার বাইরে সংক্রমণ ছড়িয়েছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। তারা বলছেন, গত ঈদের মতো এবারে যানবাহনে তেমন নিয়ন্ত্রণ চোখে পড়েনি। যার কারণে এবারেও তার ব্যতিক্রম হবে না, মধ্য আগস্টের মাঝামাঝিতে গিয়ে করোনার রোগীর আরেকটা লাফ দেখা যাবে দেশে।
প্রথম রোগী শনাক্তের পর গত মার্চ মাসে রোগী সংখ্যা ছিল ৫১ জন, মারা যান পাঁচজন, এপ্রিল মাসে শনাক্ত হন সাত হাজার ৬১৬ জন, মারা যান ১৬৩ জন, মে মাসে শনাক্ত হন ৩৯ হাজার ৪৮৬ জন, মারা যান ৪৮২ জন, জুন মাসে শনাক্ত হন ৯৮ হাজার ৩৩০ জন, মারা যান এক হাজার ১৯৭ জন, জুলাই মাসে শনাক্ত হন ৯২ হাজার ১৭৮ জন, মারা যান এক হাজার ২৬৪ জন, আর চলতি মাসে এখন পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছেন তিন হাজার ৮৫ জন, মারা গেছেন ৪৩ জন।
আইইডিসিআরের গত দুই আগস্টের তথ্য থেকে দেখা গেছে, সেদিন পর্যন্ত ঢাকা বিভাগে রোগী সংখ্যা ছিল ৭৭ হাজার ২০, চট্টগ্রামে ৩৪ হাজার ৮৪৯ জন, সিলেটে ছয় হাজার ৯৫৯ জন, রংপুরে পাঁচ হাজার ২৩০ জন, খুলনাতে ১২ হাজার ২৭১ জন, ময়মনসিংহে চার হাজার ৩৮৪ জন, বরিশালে চার হাজার ২১০ জন এবং রাজশাহীতে ১২ হাজার ৯৪০ জন।
দেশে বিভাগভিত্তিক মৃত্যু সংখ্যাতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাব থেকে জানা যায়, ঢাকা বিভাগে মারা গেছেন এক হাজার ৫০৫ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৭৬৫ জন, রাজশাহী বিভাগে ১৯০ জন, খুলনা বিভাগে ২২৯ জন, বরিশাল বিভাগে ১২৬ জন, সিলেট বিভাগে ১৫২ জন, রংপুর বিভাগে ১১৯ জন এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৬৮ জন।
গত ঈদের মতো এবারের ঈদের পরেও আবার রোগী সংখ্যা বাড়বে মন্তব্য করেছেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন। ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, এবারের ঈদ ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ এ ঈদেই মানুষ গ্রামের বাড়ি বেশি যায়, পশুর হাট বসেছে। কতজন সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে কোরবানি দিয়েছেন সেটাও আতঙ্কের একটা জায়গা। তাতে করে এবারে সংক্রমণের হারটা বেশি হবে।
কোরবানির সময়ে রোগী বাড়ার সুযোগ দেওয়া একদমই ঠিক হয়নি মন্তব্য করে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, দুই সপ্তাহ পরে রোগীর সংক্রমণের হার আর তিন সপ্তাহ পরে মৃত্যুর হার দেখা যায়। রাজধানী ঢাকার চেয়ে ঢাকার বাইরে সংক্রমণ এখন বেশি। ফেরিঘাটে-গ্রামে মানুষের মিক্সিং হবে, ঢাকার মানুষ ঢাকায় ফিরবে। একইসঙ্গে রোজার ঈদের ধাক্কাটাই এখনও সামলানো যায়নি, তার ওপর এবারের ঈদের মানুষের যাতায়াত আরেকটি ধাক্কা যোগ করবে। সবকিছু যদি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যেতো তাহলে হয়তো আগস্ট-সেপ্টেম্বর নাগাদ রোগী সংখ্যা কমে যেতো, কিন্তু সেটা না হয়ে এখন রোগী বাড়বে, আরেকটা বড় ধাক্কা অপেক্ষা করছে চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ের জন্য।
জনস্বাস্থ্যবিদ চিন্ময় দাস বলেন, মানুষের যতটা ‘ইন্টারেকশন’ হয়, ততই করোনা ছড়ায়—এটাই নিয়ম। তাই মিড আগস্ট নাগাদ রোগী সংখ্যা বাড়ার সম্ভাবনাই বেশি। তিনি বলেন, যতটা সচেতনতা তৈরি করার কথা ছিল ততটা সচেতনতা আমরা তৈরি করতে পারিনি। শুরু থেকেই স্বাস্থ্যবিধি মানানোর যে কাজ, সেটাও আমরা করিনি। মানুষও সচেতন নয়, আইন না মানার প্রবণতা তাদের ভেতরে রয়েছে, কিন্তু সে আইন না মানার কারণে তার শাস্তি কী হতে পারে তার কোনও উদাহরণ নেই আমাদের সামনে। বরং সাধারণ মানুষের ওপর দায় চাপিয়ে বলা হয়েছে, মানুষ কথা শোনে না—এটা ঠিক নয়। তাদের আইন মানাতে হবে, বাধ্য করতে হবে, কিন্তু সেটা করা হয়নি। এসব কারণে, এই সপ্তাহ থেকেই রোগী বাড়তে শুরু করতে পারে, যেটা হয়তো পিকে যেতে পারে আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে, তখন আরেকটা লাফ দিতে পারে।
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, গত ঈদের পর ঢাকার বাইরে রোগী বেশি বেড়েছে, এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। ঢাকাতেই বেশি সংক্রমিত মানুষ, তারা গ্রামে যাবে আর এই যাতায়াতের কারণে আগস্টের মাঝামাঝিতে আবার একটা ‘রাইজ’ হবে । তিনি বলেন, ঈদ শেষ হওয়ার ১৪ দিন পর থেকে সে রোগী সংখ্যা ‘শো’ করা শুরু করবে ‘ইনকিউবিশন পিরিয়ড’ শেষ হলে।