সরকারের শেষ মুহূর্তে বিভিন্ন ব্যয় মেটাতে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেয়া হচ্ছে বেশি হারে। গত ১৯ ডিসেম্বর এক দিনে ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকার ধার নিয়েছে এক হাজার কোটি টাকা। সেই সাথে ডিসেম্বরকে কেন্দ্র করে ব্যাংকগুলো আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে নগদ টাকা ছাড়া কমিয়ে দিয়েছে।
সরকারের ঋণের জোগান দিতে গিয়ে মহাবিপাকে পড়েছে কিছু কিছু ব্যাংক। যারা এতদিন আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে ধার নিয়ে চলছিল তারা নিরুপায় হয়ে সঙ্কট মেটানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে হাত পাতছে। তহবিল ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক তাই সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোকে নগদ টাকার জোগান দিচ্ছে। গত তিন দিনে সঙ্কটে পড়া এমন প্রায় ১৯টি ব্যাংককে তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা ধার দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে প্রতি ১০০ টাকার জন্য ব্যয় করতে হয়েছে ৬ টাকা থেকে ৯ টাকা পর্যন্ত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মোট সম্পদের বিপরীতে ব্যাংকগুলোর কাছে এক লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা তারল্য থাকার কথা ছিল। কিন্তু রয়েছে দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এ হিসাবে উদ্বৃত্ত রয়েছে ৮১ হাজার কোটি টাকা।
এত উদ্বৃত্ত তারল্যের মধ্যে নগদ টাকার সঙ্কট হওয়ার কারণ কি এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, ব্যাংকিং খাতে যে উদ্বৃত্ত তারল্য তার বেশির ভাগই সরকারের ঋণ আকারে রয়েছে। পরিসংখ্যান মতে, এখনো সরকারের কোষাগারে ব্যাংকগুলোর প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা ঋণ রয়েছে। বিনিয়োগ স্থবিরতার মাঝে ব্যাংকগুলো সরকারকে বাধ্যতামূলকভাবে ঋণের জোগান দিয়েছে।
সরকার ঋণের বিপরীতে বন্ড ও বিল নামক কাগুজে মুদ্রা ধরিয়ে দিয়েছে ব্যাংকগুলোকে। কিন্তু সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে যে ঋণ নিয়েছে তার বেশির ভাগই দীর্ঘমেয়াদি। সরকারকে দেয়া দীর্ঘ মেয়াদের বন্ড নগদায়ন করার মতো কোনো কার্যকর পদ্ধতি নেই। সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেট নামে আছে। ফলে নগদ অর্থের সঙ্কটে পড়া বেশির ভাগ ব্যাংকই বিপদে পড়েছে।
গত ১৯ ডিসেম্বের ১০ বছর মেয়াদে ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে এক হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে তফসিলি ব্যাংক থেকে ৩০৩ কোটি ৫০ লাখ এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৬৯৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আগামী সপ্তাহে ব্যাংকিং খাত থেকে আরো বেশি পরিমাণ ঋণ নেয়া হবে। সাধারণত সপ্তাহে দুই দিন ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে সরকার ঋণ নিয়ে থাকে। রোববার বিভিন্ন বিলের মাধ্যমে এবং মঙ্গলবার বন্ডের মাধ্যমে ঋণ নেয়া হয়। আগামী সপ্তাহে দুই দিনের পরিবর্তে চার দিন ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেয়া হবে। এতে টাকার সঙ্কট আরো তীব্র হবে।
এদিকে বছরের শেষ মাসে অর্থাৎ ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলো তাদের বার্ষিক হিসাব সমাপনী করে থাকে। এ কারণে একদিকে ব্যাংকগুলো আয়-ব্যয়ের হিসাব সমন্বয় করার জন্য নতুন কোনো ঋণ প্রদান করে না, অন্যদিকে বেশি হারে আমানত সংগ্রহ করে থাকে। এবার বার্ষিক হিসাব সমাপনী করা হবে ২৭ ডিসেম্বর। এ কারণে বেশির ভাগ ব্যাংক নতুন করে কোনো ঋণ প্রদান করছে না। একই সাথে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারেও কোনো লেনদেন করছে না।
ব্যাংকাররা জানান, একদিকে সরকারের ঋণের চাহিদা বেড়ে গেছে, অন্য দিকে বার্ষিক হিসাব সমাপনীকে কেন্দ্র করে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে লেনদেন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এতে মহাবিপাকে পড়েছে কিছু কিছু ব্যাংক। যারা এতদিন সঙ্কট মেটানোর জন্য আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার ও কলমানি মার্কেটে যেত তারা প্রয়োজন মেটাতে ঋণ পাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে হাত পাতছে। বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রাবাজারের বিশৃঙ্খলা এড়াতে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোকে ধার দিচ্ছে।
সাধারণত দু’টি পদ্ধতিতে ব্যাংকগুলোকে অর্থের জোগান দেয়া হচ্ছে। বিশেষ তহবিল সহায়তার আওতায় এবং বিল ও বন্ডের বিপরীতে ধার। সাধারণত সরকারের বাধ্যতামূলক ঋণের জোগান দেয় এমন ব্যাংকগুলোকে (প্রাইমারি ডিলার-পিডি) ১০০ টাকার বন্ডের বিপরীতে ৯৫ টাকা এবং ননপিডি ব্যাংককে ৯০ টাকা ধার দেয়া হচ্ছে।
এমনিভাবে গত ১৭ ডিসেম্বর বিশেষ রেপোর আওতায় তিনটি ব্যাংককে ৩০৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা এবং বিশেষ তারল্য সহায়তার আওতায় ছয়টি পিডি এবং ননপিডি ব্যাংককে ৬২১ কোটি ৩৮ লাখ টাকার ঋণের জোগান দেয়া হয়েছে। ১৮ ডিসেম্বর ১০টি ব্যাংককে ধার দেয়া হয়েছে এক হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, সরকার বেশি হারে ঋণ নিলে ব্যাংকগুলোর নগদ টাকার সঙ্কট আরো বাড়বে। এতে ব্যাংকিং খাতে তহবিল ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলাও আরো তীব্র হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।