নরসিংদীতে মেঘনার ভাঙনের কবলে ৭ গ্রাম

নরসিংদীতে মেঘনা নদীর ভাঙনের কবলে পড়েছে চরাঞ্চলের চার ইউনিয়নের সাতটি গ্রাম। প্রতি বছরই মেঘনার গর্ভে বিলীন হচ্ছে এসব গ্রামের ফসলি জমি, রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কবরস্থানসহ বসত ঘর-বাড়ি।

তবে, বছরের পর বছর ধরে চলা এসব ভাঙনে মানুষ ঘর-বাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হলেও ভাঙন রোধে কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রায়পুরা উপজেলার চরাঞ্চলের আট ইউনিয়নের মধ্যে চারটিই মেঘনা নদীর ভাঙনের কবলে। তার মধ্যে চাঁনপুর, চরমধুয়া, মির্জারচর ও শ্রীনগর ইউনিয়ন বছরের পর বছর ভাঙনের কবলে পড়ে বিলীন হচ্ছে শত শত একর ফসলি জমি, রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বসত ঘর-বাড়ি।

গত কয়েক দিন ধরে অব্যাহত মেঘনা নদীর ভাঙন শুরু হয়েছে চরমধুয়া ইউনিয়নের বীর চরমধুয়া গ্রামে। এতে করে এই গ্রামের প্রায় ২০/২৫টি ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। ফসলি জমি, মসজিদ, ঈদগাহ ও কবরস্থান ভাঙনে বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ইতোমধ্যে মেঘনার করাল গ্রাসে সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যাওয়ায় অন্তত শতাধিক পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। ফলে স্থানীয় গ্রামবাসী আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।

নদী ভাঙনের ফলে হুমকির মুখে আছে এই গ্রামের ঐতিহ্যবাহী বীর চরমধুয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা, বীর চরমুধয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিও। এর আগে মেঘনায় বিলীন হয়েছে গেছে একই ইউনিয়নের দড়িহাটি গ্রামের শতাধিক বাড়িঘর।

এছাড়া বিলীন হয়ে যাচ্ছে গ্রামের একটি ঐতিহ্যবাহী কবরস্থান, গাছপালা, রাস্তাঘাট, বহুআবাদি জমিসহ বিভন্ন স্থাপনা। ভাঙনে গ্রামের একমাত্র বড় কবরস্থানের বহুসংখ্যক কবর বিলীন হয়ে গেছে আগেই। গ্রামের মানুষ শত চেষ্টা করেও কবরস্থান রক্ষা করতে পারছে না।

স্থানীয়রা জানান, এ ভাঙন থেকে রক্ষার জন্য এলাকার লোকজন চরমধুয়া ইউনিয়নের পশ্চিম পাশ দিয়ে একটি বেড়িবাঁধ নিমার্ণের দাবি জানিয়ে আসছিল। এ প্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে সাবেক মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর উদ্যোগে বীর চরমধুয়া গ্রামে ৯৭ মিটার লম্বা একটি বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়। তখন স্থানীয়রা বেড়িবাঁধটি আরো ছয়শ’ মিটার বাড়িয়ে নির্মাণ করার দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু সংশ্লিষ্ট দপ্তর এ দাবি আমলে নেয়নি। ফলে প্রতি বছরেই বর্ষা মৌসুমে নদী ভাঙন দেখা দেয়। চলতি বছর মেঘনায় পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই বীর চরমধুয়া গ্রামে ভাঙন দেখা দিয়েছে।

এলাকাবাসী জানায়, প্রতি বছর বর্ষার পানি বাড়ার সাথে সাথে তীব্র ভাঙন শুরু হয়। ইতোমধ্যে চরমধূয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী আজিজুল হকের পুরো বাড়িটি নদীর গর্ভ বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়াও গত কয়েক দিনে অব্যাহত ভাঙনে আরো ২০টি ঘর নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এভাবে প্রতি বছর নদী ভাঙনের ফলে গত দুই বছরে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে ২৫০টিরও বেশি বাড়িঘর।

বীর চরমধূয়া গ্রামের কাজী আজিজুল হকের মেয়ে রোকসান বেগম জানান, এখানে তার জন্মভূমি। মেঘনা করাল গ্রাসে তার পৈত্রিক ভিটা চলে গেছে। পিতা কাজী আজিজুল হক এই ইউনিয়নের চার বারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। আজ তার শেষ স্মৃতিটুকুও নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেলো। দ্রুত এখানের ভাঙন ঠেকাতে না পারলে পুরো গ্রামটি বিলীন হয়ে যাবে।

ইয়াসমিন বেগম নামের এক বৃদ্ধা কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘এক ঘণ্টা আগেও আমার সব কিছু ছিল। মুহূর্তের মধ্যে ২০-২২ শতাংশ জায়গা আর গরুসহ গোয়ালঘর নদীগর্ভে তলিয়ে গেছে। সবকিছু হারিয়ে আমি এখন নিঃস্ব।’

চরমুধুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম শিকদার জানান, মেঘনা নদীর ভাঙন ঠেকাতে জরুরিভিত্তিতে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা প্রয়োজন। তা না হলে মানচিত্র থেকে ঐতিহ্যবাহী এ চরমধুয়া গ্রামটি হারিয়ে যাবে।

এদিকে হঠাৎ করে অব্যাহত নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে চানপুর ইউনিয়নের কালিকাপুর দক্ষিণ পাড়, সদাগরকান্দি ও ইমামদীরকান্দি তিনটি গ্রামের ১৫টি বসত বাড়ি-ঘর।

নদী গর্ভে বিলীন হওয়ার করুন দৃশ্য। নিরব দর্শকের ভূমিকায় অপলক দৃষ্টিতে দাড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোকে। নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে ফসলি জমিও। সবকিছু হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে দিন কাটাছেন অনেক পরিবার। বাড়ি-ঘর, গবাদি পশু ও মালামাল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়া মানুষগুলো মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে চিড়া, মুড়িসহ কিছু শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।

ক্ষতিগ্রস্তরা বলেন, ‘ভিটাবাড়ী না থাকলে সেমাই, চিড়া-মুড়ি দিয়ে কত দিন চলে? আগুন লাগলে অন্তত ভিটাটা তো থাকতো। মাথার ওপর কাগজ দিয়ে থাকতে পারতাম। নদী ভাঙনে তো ভিটাবাড়িসহ সব কিছু কেড়ে নিলো। একটি থালা বাসনও রাখতে পারিনি।’

রায়পুরার চাঁনপুর ইউনিয়নের কাউছার মাহমুদ বলেন, ‘এভাবে প্রতি বছরই বর্ষার মৌসুমে মেঘনা নদীর সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হচ্ছে এ এলাকার মানুষকে। গত ২০১৫ সালেও ঠিক কোরবানি ঈদের দিনে একই এলাকার ৬৪টি পরিবার মেঘনা নদীর ভাঙনে বিলীন হয়ে ক্ষতিগস্ত হয়েছিল। এবারও ঈদের কয়েক দিন আগেই মেঘনার ভাঙনে একই গ্রামেরল্ওে ১৫/২০টি বাড়ি-ঘর নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার কারণে পরিবারগুলো আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে।’

চাঁনপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মোমেন সরকার বলেন,‘ আমি ভাঙন এলাকা পরির্দশন করে শুকনো খবারের ব্যবস্থা করেছি। ইউএনও সাহেবের মাধ্যমে সরকারি সাহায্য সহযোগিতার জন্য একটি তালিকা প্রস্তুত করছি।’

অপরদিকে শ্রীনগর ইউনিয়নের পলাশতলী গ্রামে ৩০টি বসত ঘর মেঘনা নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনে ভিটে বাড়ীসহ সবকিছু হারিয়ে তারা বিভিন্ন আত্মীয় স্বজনের বাড়ি আশ্রয় নিয়েছেন। অনেক ভাঙন কবলিতরা আশ্রয় নিয়েছে পলাশতলী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও খোলা আকাশের নিচে।

এছাড়া মির্জাচর ইউনিয়নের শান্তি পুর গ্রামেও মেঘনা নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। যার ফলে ওই গ্রামের বহু পরিবার ফসলি জমি, বাড়ীঘর বসত ভিটা নদী গর্ভে হারিয়েছে।

রায়পুরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা হাতে আসলেই দ্রুত তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতার ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। চরমধুয়া ও চাঁনপুর ইউনিয়নে বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব একনেকে পাঠানো হয়েছে। আশা করছি দ্রুত সময়ের এটি বাস্তবায়ন হয়ে যাবে।’

নরসিংদীর পানি উন্নয়ন বোর্ড নির্বাহী প্রকৌশলী বিজয় ইন্দ্র শঙ্কর চক্রবর্তী জানান, রায়পুরার চরাঞ্চলে ছোটখাটো কাজ করে ভাঙন রোধ করা যাবে না। তাই চানপুর ও চরমধুয়া ইউনিয়নের দুটি পয়েন্টে দুই হাজার ৫৯৫ মিটার প্রতিরক্ষামূলক ব্লকের প্রস্তাবনা একনেকের পূর্ববর্তী সভায় অন্তর্ভুক্তি হয়েছে। আশা করছি দ্রুত বাস্তবায়ন হয়ে যাবে।’

Share this post

scroll to top