আজ হুমায়ূন আহমেদ এর অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকী।
তিনি আমাদের ছেড়ে যান ২০১২ সালের ১৯ জুলাই। মরণব্যাধি ক্যানসারের চিকিৎসায় যুক্তরাষ্ট্রে যাবার পর সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মাত্র ৬৪ বছর বয়সেই তিনি চলে যান। চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ চেষ্টা সত্ত্বেও আর ফেরেননি তিনি। সেখান থেকে মরদেহ ঢাকায় আনার পর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে লাখো মানুষের অশ্রু পুষ্পতে সিক্ত হন তিনি। ২৪ জুলাই নুহাশপল্লীর লিচুতলায় চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় এই কিংবদন্তিকে।
সেদিন তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোকে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল গোটা জাতি। হুমায়ূন আজো বেঁচে আছেন লক্ষ পাঠকের হৃদয়ে হৃদয়ে।
করোনা পরিস্থিতির কারণে কিংবদন্তি এই লেখকের প্রয়াণ দিবসে এবার আনুষ্ঠানিক তেমন কোনো আয়োজন থাকছে না। হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওন মিডিয়াকে জানিয়েছেন, প্রতিবছরের মতো এবারও পরিবারের সদস্যরা নুহাশপল্লীতে যাবে। প্রয়াতের রুহের মাগফিরাত কামনায় সেখানে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। প্রতিবছর এতিমদের খাওয়ানোর যে আয়োজন হতো, জনসমাবেশ এড়াতে এবার সেটা নেই। তবে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল হুমায়ূনের নির্মিত নাটক ও চলচ্চিত্র প্রচার করবে আজ।
নুহাশপল্লীর তত্ত্বাবধায়ক সাইফুল ইসলাম বুলবুল শনিবার জানান, দিবসটি উপলক্ষে প্রতিবছরই আগের রাতে মোমবাতি জ্বালিয়ে আলোকসজ্জা করা হতো নুহাশপল্লীতে। থাকত দিনব্যাপী কোরআনখানি, এতিমদের মধ্যে খাবার বিতরণ, ফুল দিয়ে সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন ও দোয়া মাহফিল। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় নানা আয়োজনে দিনব্যাপী স্মরণ করা হতো প্রিয় লেখককে। করোনা পরিস্থিতির কারণে এবার এসবের কোন আয়োজনই নেই।
নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন হুমায়ূন আহমেদ। কে জানতো নেত্রকোনার এই সন্তানটি একদিন হয়ে উঠবেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান জননন্দিত কথাশিল্পী, নাট্যকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগের একজন অধ্যাপক নন্দিত নরকে, লীলাবতী, কবি, শঙ্খনীল কারাগার, গৌরিপুর জংশন, নৃপতি, বহুব্রীহি, এইসব দিনরাত্রি, দারুচিনি দ্বীপ, শুভ্র, নক্ষত্রের রাত, কোথাও কেউ নেই, আগুনের পরশমণি, শ্রাবণ মেঘের দিন, জোছনা ও জননীর গল্প, এমন ঝড় তোলার মতো উপন্যাস লিখে ফেলবেন কে জানতো! আবার সে বইয়ের সংখ্যা তিন শতাধিক ছাড়িয়ে যাবে, কে জানতো!
হুমায়ূন আহমেদ এমন ঘরানার সাহিত্যিক, যিনি ছোটগল্প লিখে আলোড়ন তুলেছেন, উপন্যাস দিয়ে মোহগ্রস্ত করেছেন। সৃজনশীলতার প্রায় সব শাখায় পাঠক ও দর্শকদের নিয়ে বিশাল সাম্রাজ্য গড়েছিলেন।
বিজ্ঞানের ছাত্র হুমায়ূন আহমেদ প্রথম উপন্যাসেই যে সাড়া ফেলেন, আর পেছন দিকে তাকাবারও প্রয়োজন হয়নি। হুমায়ূনের উপন্যাসের নাট্যরূপ ধারাবাহিকভাবে টেলিভিশনে প্রচারিত হলে সেখানেও দর্শকদের সাড়া। হুমায়ূন যখন চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন তা দেখতে শহর ভেঙে পড়ে। হুমায়ূন আহমেদ চলচ্চিত্র আগুনের পরশমণি, শ্যামল ছায়া, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, নয় নম্বর বিপদ সংকেত ও ঘেটুপুত্র কমলা সবগুলোই ছিল দর্শকপ্রিয় ও ব্যবসা সফল।
চলচ্চিত্র বা নাটকের জন্য হুমায়ূন আহমেদ গান লিখেছেন, আবার তাতে সুরও দিয়েছেন, তা সমাদৃত হয়েছে।
‘যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো ’, ‘চাঁদনী পসরে কে’, ‘ও আমার উড়াল পঙ্খীরে’, ’এক যে ছিল সোনার কন্যা’, ‘আমার ভাঙ্গা ঘরে ভাঙ্গা বেড়া ভাঙ্গা চালার ফাঁকে’, ‘চাঁদনী পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়’ হুমায়ূন আহমেদের লেখা এসব গান আজো মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
বিস্ময়কর সত্য এই য়ে, টেলিভিশন নাটকে তার সৃষ্ট চরিত্রের শাস্তি যেন না হয়, তার জন্য বাংলাদেশের একাধিক জায়গায় মিছিল হয়েছিল। ধারাবাহিকের বিশেষ একটি পর্ব প্রচারিত হওয়ার পরের দিনই মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল `তুই রাজাকার` বাক্যটি। লেখায় ও লেখার উপস্থাপনায় এমনই অসাধারণ সক্ষমতা ছিল হুমায়ূন আহমেদের।
বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক `একুশে পদক` লাভ করেন। এছাড়া তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮১), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩ ও ১৯৯৪), বাচসাস পুরস্কার (১৯৮৮) লাভ করেন।
হুমায়ূন আহমেদ এর ডাকনাম কাজল। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ও মা আয়েশা ফয়েজের সন্তান তিনি। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা, আর মা ছিলেন গৃহিণী। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। কথাসাহিত্যিক জাফর ইকবাল তাঁর ছোট ভাই। সবার ছোট ভাই আহসান হাবীব নামকরা কার্টুনিস্ট ও রম্যলেখক।