ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন নামীয় সংস্থার নিবন্ধন বাতিল করেছে বাংলাদেশ সরকার। দেশজুড়ে বিতর্কিত কর্মকান্ড ও বিদেশী অনুদান আত্মসাতের দায়ে গত ২জুলাই বিতর্কিত এই সংগঠনটির নিবন্ধন বাতিল করে এনিজিও বিষয়ক ব্যুরো। এই সংগঠনটির বিরুদ্ধে দেশজুড়ে নানা রকম হয়রানি ও দুর্নীতির অভিযোগ সীমাহীন। টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন অযোগ্য ব্যক্তিদেরকে মানবাধিকার কর্মীর কার্ড সরবরাহের অভিযোগ রয়েছে। মাদকব্যবসায়ী থেকে শুরু করে অনেক বড়বড় সন্ত্রাসীরাও কথিত এই মানবাধিকার সংগঠনের কার্ড ব্যবহার করে নিজেকে মানবাধিকার কর্মী হিসেবে পরিচয় দিয়ে আসছিল। এসব কর্মীরা অনেকেই দেশের বিভিন্ন আদালত ও সরকারি অফিসে নিজেদের মানবাধিকার কর্মী হিসেবে প্রভাব বিস্তার করে চাঁদাবাজি করে আসছিল। এমন কর্মকান্ডে এই সংগঠনটির বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে উদ্ধেগ জানিয়েছিলেন তৎকালীন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। শুধু তাই নয় ‘বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন’ নামের এ সংস্থার কারণে বাইরের বিভিন্ন দেশে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্তিতে পড়ে বলেও জানিয়েছিলেন মিজানুর রহমান। হঠাৎ করে কেউ এ সংস্থার নাম শুনলে মনে করবে এ সংগঠনটি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের মতো সংবিধিবদ্ধ স্বাধীন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। মানবাধিকার কমিশন নিয়ে বিভ্রান্তি হওয়ায় কয়েকবার জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দেশবাসীকে সতর্ক করা হয়েছে। এসংগঠনটির বিরুদ্ধে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। অবশেষে কথিত এই সংগঠনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র জোরালো পদক্ষেপ নিয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে নাম বিড়ম্বনা থেকে রক্ষা করে দেশবাসীকে ভূয়া কর্মকান্ডহীন সংস্থার পরিচয় প্রকাশ করলো।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এনজিও বিষয়ক ব্যুরো থেকে এক আদেশে ঢাকার জেলা প্রশাসককে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন নামীয় সংস্থা কর্তৃক গৃহীত নগদ অনুদান এবং বৈদেশিক অনুদানে সংগৃহিত স্থাবর/অস্থাবর সম্পত্তির তালিকা তৈরি করে সরকারের দখলে নিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়াও পূবালী ব্যাংকের মালিবাগ শাখার ম্যানেজারকে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন নামীয় এ সংস্থার বৈদেশিক অনুদান গ্রহণের হিসাব নং এসবি-০৭০৩১০১০৯০৯৭৭ একাউন্টটি বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়াও জাপানের M/S/ MITSUTAKE SHOJI CO, LTD-japan এর অর্থায়নে কোন প্রকল্প বাস্তবায়না না করে এফডি-১ ফরমের 2(b) তে False Declaration দেয় কথিত এ সংস্থাটি। সেই সাথে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী এ সংস্থার নবায়ন না করেই দেশজুড়ে অবৈধভাবে কর্মকান্ড পরিচালনা করে।
এদিকে বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যমে এ কথিত সংগঠনের বিভিন্ন অনুসন্ধানী প্রতিবেদনেও বিভ্রান্তি ও সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণার বিষয়গুলো উঠে এসেছে। পাড়া-মহল্লা, অলিগলিতে এ মানবাধিকার সংগঠনের শাখা প্রশাখার অভাব নেই। সাইনবোর্ড ও প্যাডসর্বস্ব ভুঁইফোড় এ সংগঠনের কর্মকাণ্ডে ক্ষুণ্ন হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ভাবমূর্তি। নামসর্বস্ব কথিত মানবাধিকার সংগঠনগুলো লব্ধ প্রতিষ্ঠিত মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে এমনভাবে নিজেদের নাম রাখছে, যাতে বিভ্রান্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এ সংগঠনের মানবাধিকার ‘বাণিজ্য’ এখন বেশ জমজমাট।
ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা সংগঠনটি দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপপ্রচার চালানোর মাধ্যমে বিদেশি অর্থ আদায় থেকে শুরু করে থানা ও আদালতে তদবিরের মাধ্যমে অপরাধী ছাড়ানোর মতো কাজেও লিপ্ত। এমনকি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে নির্যাতিতদের আইনি সহায়তা দেওয়ার নামেও সাধারণ ভুক্তভোগী মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে তারা। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে দ্রুত বাদী-বিবাদীর কাছে পৌঁছে যান কথিত এসব সংগঠনের তদন্ত কর্মকর্তারা। তার পর সালিশ-বৈঠক ও সমঝোতা করে দেওয়ার নাম করে হাতিয়ে নেওয়া হয় টাকা।
জেলা, উপজেলা ও সিটি করপোরেশন এলাকার প্রতিটি ওয়ার্ডে মানবাধিকার সংগঠনের শাখা অফিস তৈরি করে এবং মানবাধিকারকর্মীর পরিচয়পত্র বিক্রির মাধ্যমেও টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। কথিত এ মানবাধিকার সংগঠনের পরিচালনা পর্ষদে ভূয়া সর্বজনগ্রহণযোগ্য বিচারপতি, উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ও অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের নাম রেখে প্রতারণা করা হচ্ছে। দেশের বিশিষ্ট মানবাধিকার সংগঠক ও বিচারপতিদের নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ধনাঢ্য ব্যক্তি ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কাছ থেকেও মাসোয়ারা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এদিকে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণাকারী শতাধিক মানবাধিকার সংগঠন চিহ্নিত করেছে এনজিও ব্যুরো। শিগগিরই এসব সংগঠনের নিবন্ধন বাতিলসহ আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে জয়েন্ট স্টক কোম্পানি ও ফার্মস দপ্তর।
এ প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ও রাস্তার পাশে টানিয়ে দেওয়া হয়েছে নানা চটকদার সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ডে ‘বিবাহ, তালাক, যৌতুক, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, পারিবারিক বিরোধ, জমি নিয়ে ঝামেলা, দেনমোহরসহ গরিব-অসহায়দের বিনামূল্যে আইনি সহায়তা’ দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে সাধারণ মানুষকে ফাঁদে ফেলা হয়। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েও আইনি সহায়তার নামে প্রতারণা করা হয়। অনেকে নামের মারপ্যাঁচের ঘোরে পড়ে এসব প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হয়ে মানবাধিকারের সুরক্ষা পাওয়া দূরে থাক, উল্টো হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কমিশনের পরিচয়পত্র থাকলে মোটরসাইকেল বা প্রাইভেটকার ট্রাফিক পুলিশ ধরবে না, এ কার্ড দিয়ে থানা ও সচিবালয়ে প্রবেশ করা যাবে- তাই মাত্র দুই হাজার টাকায় এ কথিত মানবাধিকার সংস্থার কার্ড কিনছেন অনেকেই।
হঠাৎ করে কেউ নাম শুনলে মনে করবে, এ সংগঠনটি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের মতো সংবিধিবদ্ধ স্বাধীন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। মানবাধিকার কমিশন নিয়ে বিভ্রান্ত হওয়ায় সম্প্রতি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে পত্রিকায় সতর্কতামূলক বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সচিব এম এ সালাম বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নাম ব্যবহার করে কিছু অসাধু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার ব্যক্তিদের আর্থিক ও মানসিকভাবে হয়রানি এবং প্রতারিত করছে। এসব অসাধু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিজেদের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিনিধি পরিচয় দিয়ে জনগণকে প্রতারিত করছে। এসব বিষয়ে মন্ত্রণালয়গুলোকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। চলতি মাসে এই বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন নামীয় ভুঁইফোড় সংগঠনের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। কথিত বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন নামীয় সংস্থাটির নিবন্ধন বাতিল করায় ভুক্তভোগীরা সরকারকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে।