চলতি আউশ মৌসুমে আবাদকৃত উচ্চফলনশীল বিনাধান-১৯ ও বিনাধান-২১ বপনের ৯৫ দিন পর কর্তনের নয়া রেকর্ড করেছে। ফলনও হয়েছে হেক্টরপ্রতি সাড়ে চার টন। কম সময়ে কম খরচে অধিক ফলন হওয়ায় বিনাধান-১৯ ও বিনাধান-২১ চাষিদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। আগামীতে ময়মনসিংহ অঞ্চলে আউশ ধানের আবাদ বৃদ্ধির উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষিবিদ ও বিজ্ঞানীরা।
ময়মনসিংহের প্রবীণ চাষিদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, এক সময় ময়মনসিংহ অঞ্চলের বিস্তীর্ণ জমিতে আউশ ধানের আবাদ হতো। একর প্রতি ১০/১২ মণ ধান উৎপন্ন হতো। স্থানীয় জাতের ধানের আবাদ করে চাষিরা উৎপাদন খরচই তুলতে পারতেন না। ফলন কম হওয়ায় দিনে দিনে আউশের আবাদ কমতে থাকে। পক্ষান্তরে বোরো মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলন হওয়ায় চাষিরা বোরো আবাদের প্রতি ঝুকে পড়লে আইশের আবাদ শূণ্যের কোঠায় নেমে আসে। বোরো মৌসুমে ধানের আবাদ বৃদ্ধির সাথে সাথে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সেচ সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করে। প্রাকৃতিক সেচের পাশাপাশি গভীর ও অগভীর নলকূপ স্থাপন করে জমিতে সেচ দিয়ে গিয়ে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়।
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতিকূল আবহাওয়ায় আবাদ ব্যাহত হয়। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে শস্যের নিভিরতা বাড়াতে বর্তমান সরকারের নির্দেশনায় বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) আউশ ধানের দু’টি উন্নত জাত বিনাধান-১৯ এবং বিনাধান-২১ উদ্ভাবন করে। যা আউশ মৌসুমে আবাদ করে হেক্টরপ্রতি উৎপাদন পাওয়া যায় গড়ে পাঁচ টন। কম খরচে কম সময়ে অধিক ফলন হওয়ায় চাষিরাও দারুন খুশি হন। আগাম ফলন হওয়ায় একই জমিতে আউশ মৌসুমে বিনাধান-১৯ এবং বিনাধান-২১, আমন মৌসুমে বিনাধান-১১ এবং খরিপ মৌসুমে সরিষার চাষ করে তিনটি ফসল ঘরে তুলতে পারছেন চাষিরা।
ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বয়রা গ্রামের কৃষক হাজী জয়নাল আবেদিন চলতি মৌসুমে বিনাধান-১৯ এবং বিনাধান-২১ আবাদ করে হেক্টরপ্রতি সাড়ে চার টন ফলন পেয়েছেন। তিনি জানান, গত দু’বছর ধরে গভীর নলকূপ অচল হয়ে পড়ায় তাদের এলাকার জমি পতিত থাকছে। এ বছর বিনার ফলিত গবেষণা ও সম্প্রসারণ বিভাগ থেকে তাঁর পতিত জমিতে বিনাধান-১৯ ও বিনাধান-২১ জাতের প্রদর্শনী প্লট স্থাপন করে সার ও বীজ প্রদান করেন। বিনাধান-১৯ এবং বিনাধান-২১ জাতের বীজ বপনের ৯৫ দিনের মাথায় তিনি কর্তন করেছেন। তিনি শুধু একবার নিড়ানি দিয়েছেন। কোনো ওষুধ ছিটাননি। সামান্য পরিমাণে সার দিয়েছেন। খুব একটা যত্ন নেননি। কিন্তু ফলন দেখে অবাক হয়েছেন নিজেই। পাড়ার অনেকেই এখন আফসোস করেছেন কেন তারা আউশের আবাদ করেননি। তবে আগামী আউশ মৌসুমে গ্রামের লোকজন বিনাধান-১৯ ও বিনাধান-২১ আবাদ করবেন বলে জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষক ও পরিচালক ড. আবুল কালাম আজাদ জানান, স্বল্প জীবনকালীন বিনাধান-১৯ ও বিনাধান-২১ খরাপীড়িত বরেন্দ্র ও পাহাড়ি এলাকাসহ উঁচু ও মধ্যম এবং বৃষ্টি নির্ভর জমিতেও আবাদ করা যায়। এদু’টি জাতের প্রধান বৈশিষ্ট হলো সেচের পানি কম লাগে। জীবনকাল কম হওয়ায় ৯৫ দিন থেকে ১০৫ দিনে ফলন ঘরে তোলা যায়। একর প্রতি ফলন পাওয়া যায় ৪০ থেকে ৬০ মন। চাল চিকন, লম্বা এবং খেতে সুস্বাদু। তবে এ জাতটি চাষ করার ক্ষেত্রে তিনটি সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। এক. যে জমিতে সব সময় পানি থাকে সেই জমিতে এই জাতের ধান চাষ না করাই ভালো। দুই. রোপনের জন্য চারার বয়স ২০ থেকে ২৫ দিন হওয়ায়ই বাঞ্চনীয়। তিন. চারা থেকে চারার দূরত্ব ৬ ইঞ্চি এবং লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব আট ইঞ্চি হতে হবে।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম জানান, এক ফসলী জমিতে তিন থেকে চারটি ফসলের আবাদ করতে হলে বোরো ধানের আবাদ কমিয়ে আগাম জাতের আউশ ধানের আবাদ বাড়াতে হবে। এতে ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমবে। একই সাথে সেচ খরচ বাবদ প্রতিবছর চাষিদের বিপুল পরিমাণ অর্থের সাশ্রয় হবে। তিনি জানান, আউশ মৌসুমে চাষিদের বড় সমস্যা হলো কর্তনের সময় বৃষ্টির কারণে ধান মাড়াই ও শুকাতে পারে না। বোরো মৌসুমে আবাদের জন্য উন্নত জাত উদ্ভাবন হওয়ায় অধিক ফলনের আশায় চাষিরা বোরোর দিকে ঝুকে পড়েন এবং দিনে দিনে আউশের আবাদ থেকে দুরে সরে আসেন। গবেষক ও সরকারের পরিকল্পনা হলো, ভূ-গর্ভস্থ পানির অভাব দুর করার জন্য আউশের আবাদ বাড়াতে হবে। সেই লক্ষ্য নিয়ে কম খরচে স্বল্প জীবনকালীন উচ্চ ফলনশীল বিনাধান-১৯ ও বিনাধান-২১ উদ্ভাবন করা হয়। যা চাষিদের জন্য খুবই লাভজনক। চলতি আউশ মৌসুমে আবাদ করে ৯৫ দিনে কম খরচে অধিক ফলন হওয়ায় চাষিদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। আগামীতে আউশ ধানের আবাদ বৃদ্ধির উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর অতিরিক্ত পরিচালক নিখিল চন্দ্র সেন জানান, গত বোরো মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলন হওয়ায় এবং দাম ভালো পাওয়ায় কৃষক লাভবান হয়েছেন। কিন্তু বোরো ধানের উৎপাদন খরচ বেশি এবং বোরো চাষে প্রচুর পানি লাগে। সময়মতো বৃষ্টি না হলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যায়। এতে সেচ খরচ বেশি হয়। তাই সরকারের নির্দেশনা হলো যেসব শস্যের উৎপাদনে পানি কম লাগে সেসব শস্যের আবাদ বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে আউশ মৌসুমে বিনাধান-১৯ এবং বিনাধান-২১ আবাদ করলে পানি কম লাগে। কম সময়ে ভালো ফলন পাওয়া যায়। উৎপাদন খরচও কম হওয়ায় আউশ মৌসুমে বিনা ধানের আবাদ বাড়ছে।
দেশে আউশের উন্নত জাত উদ্ভাবনের কারণে কয়েক বছরের ব্যবধানে ময়মনসিংহ অঞ্চলেও আউশের আবাদ ব্যাপক বেড়েছে। গেলো বছর ১৭ হাজার ৭৩৫ হেক্টর জমিতে প্রায় ৫০ হাজার মেট্রিক টন ধানের উৎপাদন হওয়ায় চলতি মৌসুমে প্রায় ২৩ হাজার হেক্টর জমিতে আউশের আবাদ হয়। এক্ষেত্রে চাষিদের প্রথম পছন্দই হলো বিনাধান-১৯ ও বিনাধান-২১ বলেও জানান তিনি।