আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ। একসময় কালাপানি হিসেবে পরিচিত ছিল এই দ্বীপপুঞ্জ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়া লোকদের এখানে পাঠানো হতো। অনেক কিংবদন্তির নামের সাথে মিশে আছে এ দ্বীপপুঞ্জ।
তবে এখনো এই দ্বীপের কথা শোনা যায়। এখানেই প্রস্তর যুগের যুদ্ধকৌশল মিশেছে ২১ শতকের অস্ত্র প্রযুক্তিতে। ১৬ নভেম্বর আমেরিকান খ্রিষ্টান মিশনারি জন অ্যালেন চাউকে আদিবাসী সেন্টিনেলিজ সদস্যরা তীর ছুড়ে হত্যা করে। তিনি খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচারের জন্য নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপে অবতরণের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আদিবাসীরা তাকে সেখানে যেতে দিতে চায়নি। তারা তাদের মতো করেই থাকতে চেয়েছে।
ওই খ্রিষ্টান ভদ্রলোককে যেখানে হত্যা করা হয়েছে, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে প্রত্যন্ত ও সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ সেটি। ভারত সরকার পর্যন্ত এখানে যেতে পারে না। সেই দ্বীপটিই মার্কিন এক ধর্মযাজকের জন্য আলোচনায় এসেছে।
তবে আন্দামানে পর্দার অন্তরালে আরো বড় কাহিনী মঞ্চস্থ হচ্ছে এবং আধুনিক ভূকৌশলগত জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ভারত উপমহাদেশের মাঝখানে অবস্থিত এই প্রত্যন্ত দ্বীপপুঞ্জে ভারত এখন অত্যাধুনিক ও অত্যন্ত সুসজ্জিত ঘাঁটি নির্মাণ করছে।
মালাক্কা প্রণালীতে টহলরত চীনা সাবমেরিনগুলোর ওপর নজরদারি চালানোর কাজটি ভারত এখন থেকেই করতে চাচ্ছে। আন্দামান ও এর পাশে অবস্থিত নিকোবর আইল্যান্ড নিয়ে ভারত গড়ে তুলেছে আন্দামান অ্যান্ড নিকোবর কমান্ড। এটিই ভারতের প্রথম ও একমাত্র ট্রাই-সার্ভিস কমান্ড।
দ্বীপপুঞ্জের প্রধান শহর পোর্ট ব্লেয়ারে এর সদরদফতর। আর নিকোবের রয়েছে তার নিজস্ব নৌবিমান স্টেশন।
ভারত মহাসাগরে চীন তার নৌ উপস্থিতি সম্প্রসারণ করার প্রেক্ষাপটে আন্দামান হয়ে পড়েছে দুই এশিয়ান জায়ান্টের জন্য ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ময়দান।
আগামী ৩০ ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আন্দামান সফর করবেন বলে কথা রয়েছে। পোর্ট ব্লেয়ারে ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও আজাদ হিন্দ ঘোষণার ৭৫তম বার্ষিকী উদযাপন হবে তার সফরের ঘোষিত উদ্দেশ্য।
আজাদ হিন্দ ছিল ১৯৪৩ সালে প্রতিষ্ঠিত অস্থায়ী সরকার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান, জার্মানির সহায়তায় এই সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
ওই যুদ্ধের সময় জাপানিরা আন্দামান ও নিকোবর দখল করেছিল। এটিই ছিল টোকিওর নিয়ন্ত্রণে থাকা একমাত্র ভারতীয় ভূখণ্ড। ওই সময় জাপানের মিত্র ছিলেন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির প্রধান সুভাষ চন্দ্র বসু। তিনি জাপানি বাহিনীর পাশাপাশি যুদ্ধ করছিলেন। ওই যুদ্ধের স্মরণে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন মোদি।
এখন জাপানি ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদীরা একই অবস্থানে রয়েছে। সেটিই এ ঘটনায় ফুটে উঠেছে। মোদি আর জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো অ্যাবে একই ধরনের ধারণায় বিশ্বাসী। অল্প সময়ের মধ্যে জাপানি নৌবাহিনীর জাহাজগুলোও পোর্ট ব্লেয়ারে উপস্থিত হবে। উভয়ের লক্ষ্য ভারত মহাসাগরে চীনকে প্রতিরোধ করা।
এ ছাড়া চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) বিরুদ্ধেও একই অবস্থানে রয়েছে জাপান ও ভারত।
আন্দামানে সামরিক কমান্ড স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে বিআরআই ধারণার আগে, সেই ১৯৯৫ সালে। ভারতের ওই সময়ের প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের মধ্যকার রুদ্ধদ্বার বৈঠকে ওই সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তত দিনে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, ভারত মহাসাগরে নিজের উপস্থিতি প্রতিষ্ঠা করতে চায় চীন। ২০০০ সালে ক্লিনটনের ভারত সফরকালে পরিকল্পনাটি চূড়ান্ত করা হয়। এর জেরে মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজ পোর্ট ব্লেয়ারে নোঙর করা হয়।
ভারত ২০১৬ সালে চীনের সাথে সামরিক প্রযুক্তিগত ব্যবধান হ্রাস করতে অস্ত্র সুবিধা লাভ করার বিনিময়ে তার নৌঘাঁটিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের কাছে উন্মুক্ত করে দেয়। বিশেষ করে চীনা সাবমেরিনগুলো শনাক্ত করতে মার্কিন সহায়তা পেয়ে আসছে ভারত।
তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প আমলে আগের মতো নিশ্চিত সহায়তা পাচ্ছে না ভারত। এ কারণে তারা জাপানের দ্বারস্থ হচ্ছে।
গত অক্টোবরে মোদির জাপান সফরকালে দুই দেশ বিভিন্ন সামরিক সহায়তার ব্যাপারে একমত হয়। বিশেষ করে নজরদারি চালানোর সুবিধা ভারত বেশি করে পাওয়ার সুযোগ লাভ করে।
ভারত মহাসাগরে চীনা উপস্থিতির যৌক্তিক কারণ রয়েছে। দেশটির বেশির ভাগ বাণিজ্য হয় এই রুট দিয়ে, এখান দিয়েই তার প্রায় সব জ্বালানি আমদানি করা হয়।
জিবুতিতে চীনের প্রথম বিদেশের মাটিতে সামরিক স্থাপনা এ জল্পনা উসকে দেয় যে, চীনা নৌবাহিনী পাকিস্তানের গোয়াদর, মিয়ানমারের কিয়াকফু ও শ্রীলঙ্কার হামবানতোতাতেও ঘাঁটি স্থাপন করবে।
মোদির আসন্ন আন্দামান সফর আসলে জাপান ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ করার একটি প্রয়াস।
বিচ্ছিন্ন সেন্টিনেলিস উপজাতির সদস্যরাও জানে না, তাদের খুব কাছাকাছি দ্বীপে কী ঘটতে যাচ্ছে। তবে বাকি বিশ্ব জানে, ভারত মহাসাগরের দিগন্তে নতুন স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা হচ্ছে, আর এই লড়াইয়ে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ হতে যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।
কিন্তু তাতে লাভবান হবে কারা? অন্তত ওই দ্বীপগুলোর মালিক যারা, তারা অন্তত নয়। প্রকৃতির নির্মলতায় বসবাস করতে চায় তারা। আধুনিক দুনিয়ার কলুষতায় বিশ্বাস করে না তারা। তাদের কিছু বুঝতে না দিয়েই তাদের এলাকা এখন ভয়াবহ প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভূমিতে পরিণত করা হয়েছে।