ফ্লাইওভারগুলো রাজধানীর পরিবহনসেবায় কিছুটা স্বস্তি নিয়ে এলেও রাতের ফ্লাইওভার এখন অনেকের কাছে ভয়াবহ আতঙ্কের নাম। রাজধানীর ফ্লাইওভারগুলোতে রাতের বেলায় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। মগবাজার ফ্লাইওভারে প্রায়ই রাতের বেলায় ফ্লাইওভারে ছিনতাইয়ের কবলে পড়ছে প্রাইভেট গাড়ি ও মোটরসাইকেল চালকরা। রাজধানীতে মহাখালী, খিলগাঁও, বনানী ও তেজগাঁও এলাকায় আরো চারটি ফ্লাইওভার রয়েছে। যানজট নিয়ন্ত্রণে এসব ফ্লাইওভার বিশেষ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু ফ্লাইওভারগুলোতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ নজরদারি না থাকায় কার্যত এগুলো অরক্ষিত।
রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ ফ্লাইওভারের ল্যাম্পপোস্টগুলোতে রাতে লাইট জ্বলে না। ফ্লাইওভারগুলোতে নেই সিসি ক্যামেরা। অভিযোগ রয়েছে, বিদ্যুৎ খুঁটির গোড়া থেকে চোরেরা বৈদ্যুতিক তার কেটে নিয়ে যাওয়ায় রাতে অন্ধকারে ডুবে থাকে ফ্লাইওভারটি।
অপরাধী ও ছিনতাইকারীদের ভয়ে রাতে ফ্লাইওভার ব্যবহারকারী প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল আরোহীরা যখন-তখন বিপদে পড়ছেন। মাদকসেবীদের আস্তানা হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে কোনো কোনো ফ্লাইওভার। বেশির ভাগ ফ্লাইওভারের নিচে ভোরবেলা ও সন্ধ্যায় চলে মাদক সেবন ও বিক্রি। আর সন্ধ্যার পর শুরু হয় ছিনতাইকারীদের উৎপাত। ফ্লাইওভারের ওপর তারা গাড়ি পার্ক করে ছিনতাইয়ের জন্য অপেক্ষা করে।
নগরবাসীর সুবিধার্থে ঢাকার সড়কপথের যানজট নিরসনে গত আট বছরে রাজধানীতে ছয়টি ফ্লাইওভার নির্মিত হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে চার হাজার ১৫৬ কোটি ২০ লাখ টাকা। দিনের বেলায় ফ্লাইওভারগুলোতে নানন্দিক সৌন্দর্য থাকলেও সন্ধ্যায় তা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের অধীনে এসব উড়াল সেতু প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। উড়াল সেতুগুলো ঘিরে সক্রিয় রয়েছে এক ধরনের ছিনতাইকারী। এ ছাড়া উড়াল সেতুর নিচের জায়গাও দখল হয়ে গেছে। এতে মাদকাসক্তদের আড্ডাসহ অপরাধ কর্মকাণ্ড বেড়েছে। গত বছর উদ্বোধনের কয়েক দিনের মধ্যেই মগবাজার-মৌচাক উড়াল সেতুর নিচে চায়ের দোকান, অবৈধ পার্কিং, ফলের দোকান, মাছের হাট বসিয়ে দখল করা হয়েছে ফাঁকা জায়গা। আর রাত হলেই উড়াল সেতুর নিচে বসছে মাদকের আড্ডা। গুলিস্তানে মেয়র হানিফ উড়াল সেতুর নিচে ঘোড়ার আস্তাবল, জুতার মার্কেট আর মুদি দোকান বসেছে। কুড়িল বিশ্বরোড উড়াল সেতুও হয়ে উঠেছে অপরাধীদের আস্তানা।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, নিয়ম না থাকার পরও উড়াল সেতুর যেখানে-সেখানে চালকরা বাস থামিয়ে যাত্রী তুলে নেয়। আর সন্ধ্যায় এ সুযোগটি নেয় ছিনতাইকারী চক্র। বাসের জন্য কোনো যাত্রী অপেক্ষমাণ থাকলে সেখানে ছিনতাইকারী এসে হানা দেয়। মাঝে মধ্যেই উড়াল সেতুর রাস্তার দুই পাশের একটি বাতিও জ্বলে না। দীর্ঘদিন ধরে এ অবস্থা থাকলেও এগুলো মেরামত করার উদ্যোগ নেই। লাইট নষ্ট থাকায় সন্ধ্যার পর ফ্লাইওভারের ওপরে ও নিচে ভুতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হয়। কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবে উড়াল সেতুর বেশির ভাগ ল্যাম্পপোস্টের বাতির তার খুলে নিয়ে গেছে চোরচক্র। মালিবাগ আবুল হোটেলের পর থেকে শান্তিনগর বাজার ও রাজারবাগ পুলিশ লাইন পর্যন্ত একই অবস্থা।
গুলিস্তানে সিএনজি অটোরিকশাচালক মাহফুজ বলেন, ‘মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের পরিবেশ অনেক খারাপ। নিচ দিয়ে হাঁটা যায় না। ঘোড়া বেঁধে রাখা হয়, ময়লার ঝুড়ি পড়ে থাকে। এ ছাড়া অন্ধকারে ছিনতাই হয়। রাতের বেলা ও পথ দিয়ে সিএনজি চালাতে ভয় লাগে।
মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার নিয়ে সিএনজি চালক রবিউল বলেন, উড়াল সেতুর কমিউনিটি পুলিশের যে বসার জায়গা, সেখানে তারা না থাকলে ভ্রাম্যমাণ মাদকসেবীরা সেখানে ভিড় জমায়। তারা আড্ডা দিয়ে মাদক সেবন করে। মাঝে মধ্যেই ফ্লাইওভারের বাতিগুলো বন্ধ থাকে। চোরেরা নাকি তার ও বাতির হোল্ডার খুলে নিয়ে গেছে।
এলজিইডি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ফ্লাইওভার নির্মাণে এলজিইডি মন্ত্রণালয় সম্পৃক্ত থাকলেও এগুলো চালু হওয়ার পর তা দেখাশোনা করার দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনের। এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বিদ্যুৎ বিভাগের নির্বাহী প্রকৗশলী নূর মোহাম্মদ জানিয়েছেন, নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় উড়াল সেতুটি আমাদের বুঝিয়ে দিতে চেয়েছে। এ বিষয়ে এখনো অনেক প্রক্রিয়া বাকি। তাই উড়াল সেতু এখনো এলজিইডির হাতেই রয়েছে। যদি উড়াল সেতুর কোনো বাতি না জ্বলে তাহলে সে দায় এলজিইডিরই।
মগবাজার-মৌচাক উড়াল সেতুর প্রকল্প পরিচালক সুশান্ত কুমার পাল জানিয়েছেন, ‘মগবাজার উড়াল সেতু চালু হয়েছে অনেক আগেই। আমরা সিটি করপোরেশনে বলেছি, তারা যেন ফ্লাইওভারের দায়িত্ব বুঝে নেয়। কিন্তু তারা সম্পূর্ণভাবে ফ্লাইওভারের দায়িত্ব বুঝে নিচ্ছে না।
মগবাজার-মৌচাক উড়াল সেতুর বাতি না থাকায় যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ‘অভিভাবকহীন’ এ উড়াল সেতুটি দিয়ে উল্টোপথে চলে মোটরসাইকেল, অটোরিকশা, এমনকি বাসও।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) কর্মকর্তারা জানান, ল্যাম্পপোস্টের খুঁটির গোড়া থেকে বিদ্যুতের তার কেটে নেয়ায় বাতি লাগানো যাচ্ছে না। এ ছাড়া সিসি ক্যামেরা লাগিয়েও তা রক্ষা করা যাচ্ছে না। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই সব চুরি হয়ে যায়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক জানিয়েছেন, ‘উড়াল সেতুগুলোতে বাতি জ্বলে না এটি তো পুরনো সমস্যা। নগরবাসীর দুর্ভোগ কমানোর জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করে উড়াল সেতু বানানো হলেও নানা অব্যবস্থাপনার কারণে উড়াল সেতুগুলোতে কাঙ্ক্ষিত সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।