চন্দ্রজয়ের পর কাছাকাছি দূরত্বের অন্য গ্রহগুলোতে পদচিহ্ন রাখার লক্ষ্যে মানুষ নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় আশির দশকে বেশ কয়েকবার সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন মহাকাশ সংস্থা মঙ্গল গ্রহে সফলভাবে মহাকাশযান অবতরণে সক্ষম হয়। এরপরই পৃথিবীর বাইরে মঙ্গল গ্রহে মানুষের বসবাসযোগ্য আবাসস্থল গড়ে তোলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নতুন উদ্যোমে কাজ শুরু করেন বিজ্ঞানীরা।
‘লাল গ্রহ’ হিসেবে পরিচিত মঙ্গলের বৈরী আবহাওয়ায় বেঁচে থাকাটাই হলো আসল চ্যালেঞ্জ। মঙ্গলে পাঠিয়ে দেওয়া হলে আপনি অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এই গ্রহের তীব্র তেজস্ক্রিয়তায় ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাবেন। শুধু কি তাই! অ্যান্টার্কটিক অঞ্চলের চেয়ে তীব্র ঠান্ডা মঙ্গলের আবহাওয়া। তার ওপর মঙ্গলের বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের আধিক্য। আর মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলীয় চাপ খুবই কম হওয়ায় বাইরের তাপমাত্রার প্রভাবে আপনার রক্ত রীতিমতো ফুটতে শুরু করবে। তাই এই গ্রহে ল্যান্ড করার পর কোনো মানুষই স্বাভাবিকভাবে বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারবে না। বুঝতেই পারছেন, মঙ্গলে বসতি গড়ার ব্যাপারটা খুব সহজ নয়।
ক্যালিফোর্নিয়ার সার্চ ফর এক্সট্রা টেরিস্ট্রিয়েল ইনটেলিজেন্স (এসইটিআই) ইনস্টিটিউটের সিনিয়র প্ল্যানেটারি সায়েন্টিস্ট ড. প্যাস্কেল লি’র মতে, মঙ্গলে পা রাখার পর অন্য কোনো প্রতিক্রিয়া ঘটার আগেই আপনি ঠান্ডায় জমে মারা যাবেন। তিনি আরো যোগ করেন, পৃথিবীর পরিবেশ এবং চৌম্বকীয় ক্ষেত্র প্রাকৃতিকভাবেই মানুষের বসবাসযোগ্য। কিন্তু মঙ্গলে এরকমটা নেই। তাই মঙ্গলে বসবাস করতে হলে কৃত্রিমভাবে পরিবেশ তৈরি করে নিতে হবে। এছাড়াও ওখানে বেঁচে থাকতে হলে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন এবং পানি সরবরাহ করার ব্যবস্থাও করতে হবে। আর মঙ্গলের বিষাক্ত আবহাওয়া থেকে বাঁচতে কৃত্রিমভাবে গ্রীনহাউসের আদলে চারপাশে আলাদা আবরণ তৈরি করতে হবে।
তবে অনেকে এগুলোকে বড় বাধা হিসেবে দেখেন না। কিন্তু মঙ্গলে মানব বসতি স্থাপনের আগে সম্পূর্ণ সুরক্ষাব্যবস্থা তৈরি করে নিতে হবে- এর কোনো বিকল্প নেই।
তবে এটা ঠিক মঙ্গলে অবকাঠামো তৈরির প্রস্তুতি চলছে। গবেষণা থেমে নেই। মার্স ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের প্রধান প্রকৌশলী পল ওস্টার বলেছেন, আমরা এমন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের চেষ্টা করছি যাতে স্টারশিপের ভেতর বসেই মঙ্গলে যাওয়া মহাকাশচারীরা অবকাঠামো তৈরির কাজ করতে পারেন।’
স্পেসশিপের ভেতর বসে বাইরে কাজ করার এই ধারণা নতুন নয়। ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত মার্স সোসাইটির মঙ্গলে মানব বসতি নিয়ে কাজ করছে। তাদেরও প্রায় একই পরিকল্পনা। মঙ্গলে অবকাঠামো তৈরির জন্য পাঠানো নভোচারী এবং প্রকৌশলীদের জন্য তাবুর আদলে ছোট ক্যাম্প করা হবে। ক্যাম্পগুলো একটা আরেকটার সঙ্গে লাগোয়া থাকবে। সেখান থেকেই অবকাঠামো তৈরির সমস্ত কাজ পরিচালনা করবেন তারা। তাদের দাবি, ২০৩০ সালের মধ্যেই মঙ্গলে পা রাখবে মানুষ এবং অবকাঠামো তৈরি হতে প্রায় ১০ বছরের মতো সময় লাগবে। অর্থাৎ ২০৪০ সালের দিকে পৃথিবীর বাইরে দ্বিতীয় কোনো গ্রহ হিসেবে মঙ্গলে বসতি স্থাপন করবে মানুষ।
নাসার সাবেক ফিজিশিয়ান জিম লোগান বলেন, মঙ্গলের ভূ-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৯ ফুট নিচে যদি আবাস নির্মাণ করা হয় তাহলে তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ অনেক কমে যাবে। এছাড়া ভূ-পৃষ্ঠের উপরের অন্যান্য বিপদ যেমন সৌর ঝড় ইত্যাদি থেকেও রেহাই পাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে পুরোনো আগ্নেয়গিরির মুখ বা ভূগর্ভস্থ গুহাগুলো হতে পারে আদর্শ জায়গা। তবে শুধু আবাসন ব্যবস্থা তৈরি করলেই তো হবে না। প্রয়োজনীয় পানি, খাদ্য, জ্বালানি এবং অন্যান্য কাঁচামালের বিষয়গুলোও মাথায় রাখতে হবে। এ প্রসঙ্গে মহাকাশ গবেষক স্টিফেন পেট্রেনেক ‘হাউ ইউ উইল লাইভ অন মার্স’ গ্রন্থে লিখেছেন: ‘শুরুর দিকে বেশ কয়েক বছর মঙ্গলবাসীদের জন্য সমস্ত উপকরণ পৃথিবী থেকেই সরবরাহ করতে হবে।’
আশার কথা হলো যে, মঙ্গল গ্রহে পানির উপস্থিতি পাওয়া গেছে। বাতাসেও জলীয় কণার সন্ধান পেয়েছেন গবেষকরা। এছাড়াও বরফাচ্ছন্ন এলাকাগুলোর নিচে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পানি পাওয়া যাবে বলেও ধারণা তাদের। মঙ্গলে আমাদের গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের চেয়েও আট গুণ দীর্ঘ এবং চারগুণ গভীর এক গিরিখাতের সন্ধান পাওয়া গেছে। যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ভ্যালস মেরিনারিস’। এই জায়গাটিকেই মঙ্গলে মানব বসতির জন্য পছন্দের শীর্ষে রাখা হয়েছে।
মঙ্গল গ্রহে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম তৈরির বিষয়টিকেই এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন ইলন মাস্কসহ অন্যান্যরা। যারা মঙ্গলে আবাসন নিয়ে কাজ করছেন। দীর্ঘমেয়াদি নানা পরিকল্পনা করা হচ্ছে এবং সেগুলো বাস্তবায়নের কাজও চলছে পুরোদমে। তবে অগ্রাধিকার পাচ্ছে ‘বাবল সিটি’ মডেলটি। মডেলটি অনেকটা এরকম- মঙ্গলে তৈরি করা গোটা একটা শহরের বাইরে বিশেষ এক আবরণ এই গ্রহের বৈরী পরিবেশ এবং তেজস্ক্রিয়তা থেকে রক্ষা করবে। আর এই শহরের ভেতরের আবহাওয়া হবে পৃথিবীর অনুকূল। এখন অপেক্ষা স্বপ্নপূরণের।