‘শালুক ফুলের লাজ নাই, রাইতে শালুক ফোটে’

ভোরে আজানের অপেক্ষায় ছিলাম। আগে থেকেই ঠিক করা ছিল আমাদের ভ্রমণ-স্থান। যেতে হবে সকাল সকাল। কারণ রোদের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুটন্ত রক্তলাল শাপলা লজ্জায় পাপড়ি গুটিয়ে নেয়। আমরা যাচ্ছি শাপলার জন্য বিখ্যাত বিল সাতলা দেখতে। ‘শাপলার গ্রাম’খ্যাত সাতলা এবং এর পার্শ্ববর্তী গ্রামজুড়ে একাধিক বিলে ফুটে থাকা শাপলার হাসি দেখলে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই।

খুব সকালবেলা ছুটে চলেছে আমাদের বাস; বরিশাল নথুল্লাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে আলো ফোটা সকালেই আমাদের যাত্রা শুরু হয়। সঙ্গে আছে আমার ৮ বন্ধু। সকলেই উৎফুল্ল শাপলার বিল দেখবে বলে। বাসের জানালা দিয়ে হু হু হাওয়া শরীর ঠান্ডা করে দিচ্ছিল। একসময় আমাদের নিয়ে বাসটি ধামুরা হয়ে সাতলার পথে মোড় নিলো। কিছুক্ষণ পরেই বাস এসে সাতলা থামল।

পথের একপাশে সন্ধ্যা নদী, অন্যপাশে লাল শাপলার সাতলা বিল প্রথম দেখাতেই মন কেড়ে নিলো। যা ভেবেছিলাম তার চেয়েও অপরূপ সেই দৃশ্য। যত দূর চোখ গেল, লাল শাপলার মুগ্ধকর শোভা! বরিশাল সদর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরত্বে উজিরপুর উপজেলার সাতলা গ্রামের এই বিল যেন প্রাকৃতিক স্বর্গ! সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি বাংলাদেশের এ যেন আরেক রূপ। তাই প্রতিনিয়ত শাপলা গ্রামে ভিড় বাড়ছে পর্যটকের।

সাতলা বিলে লাল শাপলার আধিক্য বেশি, সাদা শাপলার উপস্থিতি তুলনামূলক কম। জ্যৈষ্ঠ থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত এ অঞ্চলের বিলগুলোতে পানি থাকে। ভাদ্র-আশ্বিন-কার্তিক এই তিন মাস বিলগুলোতে প্রচুর শাপলা জন্ম নেয় প্রাকৃতিকভাবে। বছরের এই সময় বিল ভরা শাপলা থাকায় সাতলার জনপদজুড়ে আসে আনন্দ। শুধু সৌন্দর্যের জন্য নয়, এখানকার দরিদ্র মানুষগুলো শাপলানির্ভর কর্মযজ্ঞ করে আর্থিকভাবে টিকে থাকে। এ সময়টায় কৃষি কাজের চাপ না থাকায় কৃষিজীবী পরিবারগুলোর কাছে শাপলা যেন আশীর্বাদ হয়ে ধরা দেয়। গৃহকর্তারা বিলের পানিতে বৈঠা চালান, নৌকায় বসে পুত্র বা কন্যাটি টেনে টেনে নৌকায় তোলে শাপলা। পরিবারের গিন্নি শাপলাগুলো গুছিয়ে আটি বাঁধেন হাটে পাঠানোর তাগিদে। সকালের আলোর তীব্রতা বাড়ার আগেই শাপলাগুলো নিয়ে হাটে যেতে হয়। তাই খুব সকাল থেকে শুরু হয় পারিবারিক কর্মযজ্ঞ। স্থানীয় বাজারে প্রতিটি শাপলার আটি বিক্রি হয় ৮ থেকে ১০ টাকা।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বছরের এই সময় জল্লা ইউনিয়নের হারতা, বাগদা, কারফা, সাতলা, পশ্চিম কালবিলাসহ ৭ থেকে ৮টি গ্রামের প্রায় ৫০টি পরিবারের জীবিকা চলে শাপলা সংগ্রহ ও বিক্রির মাধ্যমে। এ অঞ্চলে বড়-ছোট প্রায় ২০টি বিল রয়েছে, যেখানে প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নেয় আমাদের জাতীয় ফুল।

আমরা নৌকা ভাড়া করলাম, বড় কালবিলা ঘাট থেকে নৌকা নিয়ে মাঝবিলে ঘুরে আসা ছিল আমাদের ভ্রমণের প্রধান উদ্দেশ্য। শাপলার মাঝ দিয়ে যখন আমাদের নৌকা ছলাত ছলাত শব্দ তুলে এগিয়ে যাচ্ছে তখন আমরাও শাপলা তুলতে লাগলাম। শাপলা ফুলের নরম পাপড়ির স্পর্শ মন ছুঁয়ে গেল। শরৎ কালের মনকাড়া মৃদু হাওয়ায় সেগুলো কাঁপছিল। মনে হচ্ছিল কোনো লাল রঙের ফুলের বিছানায় আমি-আমরা ঘুমিয়ে আছি।

রোদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। মাঝি জানাল এখন শাপলা ফুলের ঘুমের সময়। কথা শুনে চমকে উঠলাম। সত্যি কী তাই? ভালো করে লক্ষ্য করলাম ফুলগুলো ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ছে। পানির উপর সূর্যের সোনালী রোদ পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়তেই শাপলাগুলো নিজেকে যেন গুটিয়ে নিতে শুরু করল। শাপলা ফুল জেগে থাকে রাতে। এজন্যই কবিয়াল গান বেঁধেছেন: ‘শালুক ফুলের লাজ নাই, রাইতে শালুক ফোটে লো…’

আমরা সবাই মিলে গাইতে শুরু করলাম সেই গান। ওদিকে মাথার ওপর  রোদ তাড়া দিচ্ছিল- একটু ঘুমোতে দাও রাতভর জেগে থাকা ক্লান্ত শাপলাগুলোকে। মায়াবি সেই শাপলাগুলোকে বিদায় জানিয়ে আমরা শেষ করলাম সেদিনের ভ্রমণ।

Share this post

scroll to top