দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম পর্যটন অঞ্চল কুয়াকাটা। করোনার প্রভাবে স্থবির হয়ে পড়েছে এই অঞ্চল। তবে এখানকার প্রকৃতি যেন ফিরে পেয়েছে প্রাণ। মানবশূন্য কুয়াকাটার প্রকৃতি আগের চেয়ে অনেক বেশি সজীব এবং উজ্জ্বল। বিশাল বিস্তৃত নির্জন সৈকতে এখন শুধু সমুদ্রের গর্জন। ঢেউগুলো আছড়ে পড়ছে বেলাভূমিতে। সমুদ্রের পানি আগের চেয়ে কিছুটা নীল। বেলাভূমিতে যত্রতত্র পড়ে নেই মানুষের ফেলে যাওয়া প্লাস্টিক, চিপসের প্যাকেট, ছেঁড়া কাগজ বা বোতল। কুয়াকাটার সূর্য উদয় আর বিকেলের সূর্যাস্ত এখন আরো মনোহর।
কিন্তু এমন মনোহর প্রকৃতি দেখতে কুয়াকাটায় নেই কোনো পর্যটক। স্বাভাবিকভাবেই কুয়াকাটায় ধস নেমেছে পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যবসা-বাণিজ্যে। পর্যটকদের নানা ধরনের সেবাদানের মাধ্যমে যারা জীবিকা নির্বাহ করত এমন পরিবারগুলো পড়েছে চরম অনিশ্চয়তায়। সবার মনে এখন একটাই প্রশ্ন— কবে পরিত্রাণ মিলবে এই পরিস্থিতি থেকে? কবে স্বাভাবিক হবে জনজীবন? আবার কবে আসতে শুরু করবে পর্যটক?
পটুয়াখালী জেলার কুয়াকাটায় পর্যটকদের আবাসিক সেবা দিতে গড়ে উঠেছে শতাধিক হোটেল-মোটেল। এখন পর্যটকদের হোটেলে স্থান দিলে, গুণতে হবে জরিমানা। এ নিয়ম বেঁধে দেয়া হয়েছে প্রশাসন থেকে। এসব হোটেলে কর্মরত রয়েছে তিন শতাধিক কর্মচারী। জানা যায়, ৭০ শতাংশ হোটেলে গত ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাসের কর্মচারী বেতন বকেয়া পড়েছে। ফলে হোটেলে কর্মরত শ্রমিকদের দিন কাটছে চরম উদ্বেগে।
এছাড়াও পর্যটকদের খাবারের চাহিদা পূরণ করতে গড়ে উঠেছে একাধিক রেস্তোরাঁ। সেগুলো প্রায় সবই বন্ধ। এসব রেস্তোরাঁর মালিক, কর্মচারী কেউই জানেন না কবে ফিরবে তাদের সুদিন। আর কতদিন দেখতে হবে পর্যটকশূন্য কুয়াকাটার অচেনা রূপ?
একাধিক স্থানীয় সূত্র থেকে জানা যায়, সৈকতে গড়ে উঠেছে ২৩টি কাঁকড়া ও ফিশ ফ্রাইয়ের দোকান। সৈকতের নির্ধারিত পয়েন্টে একটি শুঁটকি মার্কেট রয়েছে, যেখানে দোকান রয়েছে ২৮টি। এর সন্নিকটে পোষাকের দোকান রয়েছে প্রায় ২০টি। ছবি প্রিন্ট ও এডিটিং স্টুডিও রয়েছে ১০-১৫টি। কুয়াকাটায় দর্শনার্থীদের চাহিদা অনুযায়ী নানা ধরনের বার্মিজ আচার- চকলেট বিক্রির দোকান রয়েছে কমপক্ষে ৮০টি। কারুপণ্য কিংবা ঝিনুক বিক্রি করা হয় এমন দোকান রয়েছে প্রায় ১২০টি। এসব দোকানের মালিক, কর্মচারী সবাই এখন কর্মহীন। পর্যটকশূন্য কুয়াকাটায় তাদের বেচাকেনাও শূন্য। এদের চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি একইরকম দুশ্চিন্তায় পড়েছেন সৈকতের ভ্রাম্যমান হকার, চটপটি কিংবা ফুচকা বিক্রেতারা। জনশূন্য বন্ধ দোকানের দিকে তাকিয়ে আছেন সৈকতের ডাব বিক্রেতারা।
স্থানীয় পরিবহণ খাতে যারা জড়িত তারাও পড়েছেন বিপাকে। সৈকতের এসব ব্যবসায়ী ছাড়াও পর্যটকের উপরে নির্ভরশীল এখানকার রাখাইন মার্কেট। মার্কেটে প্রধানত বিক্রি হয় রাখাইনদের হাতে বোনা তাত বস্ত্র, হস্তশিল্প কারুপণ্য, বারমিজ জুতা, রাখাইন আচার। স্থানীয় প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞায় মার্কেট বন্ধ। জানা যায়, কুয়াকাটা তরুণ ক্লাবের উদ্যোগে স্থানীয় কিছু পরিবারকে কিছু খাদ্য-পণ্য সহায়তা দেওয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। ফলে কোনোভাবেই দুশ্চিন্তা কাটছে না কর্মহীন, অসহায়, দুস্থদের।
স্থানীয় ভ্যানচালক জলিল মিয়ার (৫০) কণ্ঠেও করোনা সংকটের কথা। তিনি বলেন, ‘ছেলেমেয়ে নিয়ে কীভাবে বেঁচে থাকব চিন্তা করতে পারতেছি না। আমরা যারা দিন আনি দিন খাই তাদের এভাবে কতদিন চলবে? সৈকতের চারপাশ আগের চেয়ে অনেক সুন্দর! কিন্তু কপাল দেখেন কোনো মানুষ নাই!’
স্থানীয় শুঁটকি দোকানি হামিদ মিয়ার মুখেও ভবিষ্যৎ দুশ্চিন্তার স্পষ্ট ছাপ। তিনি বলেন, ‘করোনার শুরু থেকেই কুয়াকাটা পর্যটকশূন্য। তখন দোকান খুললেও কয়েকদিন ধরে বিক্রি ছিল না। এখন তো দোকানই খুলি না। মানুষ নাই। সৈকতে এখন অনেক পাখি আসে। আগে আসত না। কচ্ছপও চোখে পড়ছে। সবই ঠিক ছিল কিন্তু এসব দেখার জন্য মানুষ যদি বেড়াতেই না আসে তাহলে আমাদের জীবন চলবে কীভাবে?’
কুয়াকাটা তরুণ ক্লাবের সভাপতি ইব্রাহিম ওয়াহিদ বলেন, ‘কুয়াকাটায় ৮০ শতাংশ মানুষ পর্যটক নির্ভর। মানুষগুলো কর্মহীন হয়ে পড়ায় তাদের পরিবারে অভাবের ছাপ পড়তে শুরু করেছে। এমন পরিস্থিতিতে পর্যটন খাতে জড়িত এই মানুষগুলোকে যতটা সহযোগিতা দেয়া দরকার, তা দিতে পারছি না। তবে চেষ্টা করছি। যে কারণে কুয়াকাটার নতুন এই প্রকৃতির রূপ প্রাণভরে উপভোগ করতে পারছি না। মনে উল্টো ভয়, আর্থিক এই দুরবস্থা সামাজিক অবক্ষয়ের কারণ হতে পারে।’