কিম জং উন: এই সময়ের ‘পাগলা রাজা’

আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, এই মুহূর্তে বিশ্বে কোন শব্দটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে? আপনি চোখ বুজে বলবেন- করোনাভাইরাস!

এরপর?

এরপরই আসবে কিম জং উনের নাম। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির মধ্যেও ‘টক অব দি ওয়ার্ল্ড’ উত্তর কোরিয়ার এই নেতা। সুতরাং বুদ্ধিমান পাঠকের এতক্ষণে বুঝে ফেলা উচিত, এই নেতার নামের শেষ শব্দটি ‘উন’ হলেও, তিনি মোটেই ঊন নন, উনপাঁজুরে তো নন-ই।

কিম জং উন বিভিন্ন সময় তার নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আলোচিত হয়েছেন। কঠোর, একগুঁয়ে, রহস্যময় শব্দগুলো তার নিত্যসঙ্গী। তার খামখেয়ালিপনা বিশ্বনেতাদের মাথাব্যথার কারণ! এই যেমন, বিশ্ব যখন করোনা নিয়ে ত্রাহি রব ছাড়ছে তখন তিনি আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করে, বেশ কয়েকবার পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছেন। লকডাউন সফল করতে পরিষ্কার ঘোষণা দিয়েছেন- ঘরের বাইরে যাকে দেখা যাবে সঙ্গে সঙ্গে গুলি। না। এগুলো তার গালগল্প নয়। কারণ দেশবাসী এর চেয়েও কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে তাকে দেখেছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে কিম জং উন। পরস্পর ভালো বন্ধু দাবি করলেও বাস্তবতা ভিন্ন

সম্প্রতি উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী এই নেতার মৃত্যুর খবর নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। ফলে নতুন করে তিনি আলোচনায় উঠে এসেছেন।

কিম জং উন উত্তর কোরিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ও মার্ক্সবাদী সমাজতান্ত্রিক নেতা কিম ইল সাং-এর নাতি। বাবার নাম কিম জং ইল। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা ছিলেন। তার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারী হিসেবে ক্ষমতায় আসেন কিম জং উন। তার এভাবে ক্ষমতায় আসাটাও অভিনব এবং ভাগ্যসাপেক্ষ।

পারিবারিকভাবে ক্ষমতার উত্তরাধিকার হওয়া কিম জং উনের বেড়ে ওঠা অনেকটা গোপনে। এমনকি তার জন্মসাল নিয়েও আছে বিতর্ক। বিষয়টিকে অবশ্য ‘বিতর্ক’ বলার সাহস তার দেশের কোনো নাগরিক রাখেন না। রাখবেন কীভাবে, তার দেশের কোনো নাগরিক কিম জং উনের মতো চুলের ছাঁট পর্যন্ত দিতে পারেন না- এটাও সে দেশে আইন! তবে, বিশ্ব রাজনীতির বিশ্লেষকদের মতে, কিম জন্মগ্রহণ করেন ১৯৮৩ বা ৮৪ সালের ৮ জানুয়ারি। তবে দেশটির নথিপত্র অনুযায়ী উনের জন্মতারিখ এক বছর পূর্বে ১৯৮২ সালে। এর কারণ হিসেবে মনে করা হয়, ওই বছর তার পিতামহ ইল সাং-এর জন্মের ৭০ বছর এবং তার পিতা জং ইল-এর জন্মের ৪০ বছর পূর্তি হয়। এর সঙ্গে মিল রাখার স্বার্থেই সরকারি নথিপত্রে তার জন্মতারিখ ১৯৮২ সাল উল্লেখ করা হয়েছে।

চলছে পারমাণবিক মহরা। দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করছেন কিম জং উন

কিমের মা কো ইউং হি তার বাবার তৃতীয় স্ত্রী। মোট তিন ভাইয়ের মধ্যে কিম সর্বকনিষ্ঠ। কৈশোরে তিনি মায়ের সঙ্গে সুইজারল্যান্ডে থেকেছেন। সেখানেই পড়াশোনা। তার এই স্কুলজীবন ছিল বেশ গোপনীয়। নিরাপত্তার স্বার্থে ছদ্মপরিচয়ে তাকে স্কুলে ভর্তি করা হয়। তবে পড়াশোনায় তিনি খুব একটা ভালো ছিলেন না। এখন যতটা ডাকাবুকো স্বভাবের তাকে দেখা যায়, ছেলেবেলায় তিনি ছিলেন ঠিক তার উল্টো। মেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে মেশায় ছিল বেজায় অনাগ্রহ। বাস্কেটবল খেলতে পছন্দ করতেন এবং মাইকেল জর্ডানের প্রতি তার ছিল বিশেষ আগ্রহ- বলা যায় আইকন! পাঠককে এই ফাঁকে জানিয়ে রাখি, দীর্ঘদিন উত্তর কোরিয়ার বাইরে কিম জং উনের একটি মাত্র ছবি প্রকাশিত ছিল। ছবিটি তোলা হয়েছিল তার ১১ বছর বয়সে। এটিও তার নিরাপত্তার কথা ভেবেই করা হয়েছিল।

কিম জং ইল-এর কনিষ্ঠ পুত্র হওয়া সত্ত্বেও তিনি পিতার উত্তরাধিকারী হিসেবে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করেন। যদিও বিশ্লেষকদের ধারণা ছিল, জং ইল-এর বড় ছেলে এবং কিম জং উন-এর সৎ ভাই কিম জং ন্যাম কিংবা জং উন-এর আপন ভাই কিম জং চুল হয়তো পিতার ক্ষমতার উত্তরাধিকার মনোনীত হবেন। তবে কিম জং ন্যাম ২০০১ সালে জাল পাসপোর্টে জাপানে প্রবেশের সময় ধরা পড়ে বাবার বিরাগভাজন হন। তাকে দেশান্তরী করা হয়। পরে তিনি সেখানেই আততায়ীর হাতে মারা যান। তার আপন ভাই কিম জং চুলের মধ্যে কিছুটা মেয়েলি স্বভাব থাকায় তাকেও ক্ষমতার উত্তরাধিকারী মনোনীত করা হয়নি বলে জানান, কিম জং ইল-এর ব্যক্তিগত রাঁধুনী কেনজি ফুনজিমোটো। এই ভদ্রলোক উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে এসে আত্মজীবনী লেখেন। সেখানে এ কথার উল্লেখ আছে। তো এভাবেই কিম জং উনের ক্ষমতা গ্রহণের সুযোগ চলে আসে হাতের মুঠোয়। এছাড়া তার  মধ্যে পিতার ব্যক্তিত্বের ছাপ থাকায় তিনিই হয়ে ওঠেন পিতার প্রথম পছন্দ।

২০১০ সালের ১০ অক্টোবর ওয়ার্কার্স পার্টির ৬৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে পিতার পাশে তার আসন দেওয়া হয়। তখনই ওয়ার্কার্স পার্টির পরবর্তী নেতৃত্ব নিয়ে সকলের ধারণা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ধারণা সত্য হয় ২০১১ সালের ১৭ ডিসেম্বর। এই দিন ওয়ার্কার্স পার্টি কিম জং উনকে তাদের সর্বোচ্চ নেতা ঘোষণা করে। ২৪ ডিসেম্বর তাকে উত্তর কোরিয়ান পিপলস আর্মির সুপ্রিম কমান্ডার ঘোষণা করা হয়। ৩০ ডিসেম্বর থেকে তিনি উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ সময় তার বয়স ছিল বিশের কোঠায়। ততদিনে অবশ্য বাবা কিম জং ইল পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তবে মৃত্যুর আগে সন্তানের জন্য তিনি পাকা বন্দোবস্ত রেখে যান। যেমন নিয়মের তোয়াক্কা না করেই তিনি কিম জং উনকে ২০১০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর চার তারকা সমমান জেনারেল নির্বাচিত করেন। অথচ সেনা সম্বন্ধীয় কোনো প্রকার পূর্ব অভিজ্ঞতাই তার ছিল না! ছেলেকে তৈরি করতেই তিনি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

অস্ত্র পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত উন

কিম জং উন উত্তর কোরিয়ার সামরিক অগ্রগতির জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। প্রতিজ্ঞায় তিনি এতোটাই কঠোর যে, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করে ২০১৬ সালে তিন তিনবার পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছেন। এর পরের বছর যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় চালিয়েছেন ব্যালাস্টিক মিসাইল উৎক্ষেপনের পরীক্ষা। ফলে একাধিকবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে তার উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়েছে। এমনকি তিনি ট্রাম্পকে ‘পাগল’ বলতেও ছাড়েননি। তবে ২০১৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে ইন-এর সঙ্গে এক আলোচনায় তিনি পরমাণু অস্ত্র এবং ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপনের পরীক্ষায় বিরতির কথা জানান।

কিম জং উন ক্ষমতায় এসেই বাবার প্রশাসনের আস্থাভাজন অনেক কর্মকর্তাকে ছাটাই করে দেন। অনেককে তিনি ছাটাই করেই ছেড়ে দেননি, প্রাণদণ্ড দিয়েছেন। এর মধ্যে তার আপন চাচা জাং সং থায়েকও রয়েছেন। জং ইলের শাসনামলে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এবং তিনি জং উনেরও উপদেষ্টা ছিলেন। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তার পরিবারের সকলকেও একইভাবে হত্যা করা হয়। ২০১৭ সালে তার সৎ ভাই কিম জং ন্যামকে মালয়েশিয়াতে স্নায়ুতন্ত্রের ওষুধ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয়। সেখানেও জং উনের হাত রয়েছে বলে মনে করা হয়। উত্তর কোরিয়ার জনগণের উপর অত্যাচার চালানো এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে জাতিসংঘ তার বিরুদ্ধে করা তদন্ত প্রতিবেদনে তাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে জবাবদিহিতার সুপারিশ করে। যদিও এর কোনো কিছুই কিম জং উনকে বিচলিত করেনি।

উত্তর কোরিয়ার জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা খুবই সীমিত। জনগণের কাজকর্মের উপর সার্বক্ষণিক রাষ্ট্রের নজরদারী চলমান। তবে কিম জং উন দেশটির সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর সেখানকার অর্থনীতিতে সংস্কার করেছেন। বাজার অর্থনীতির সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য ব্যবসায়ীদের কিছুটা স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। তার পিতার চেয়ে জনগণের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা এবং জনগণের কল্যাণে তার আগ্রহ অনেক বেশি।

স্ত্রী রি সোল জুর সঙ্গে কিম জং উন

কিম জং উন বিয়ে করেছেন এই খবর প্রথম গণমাধ্যমে আসে ২০১২ সালের মাঝামাঝি সময়ে; বিয়ের তিনবছর পর। এর আগে এ বিষয়ে বাইরের কেউ জানতে পারেনি। এক মেয়ের বাবা কিম জং উন বিলাসী জীবানযাপনে অভ্যস্ত। এ নিয়ে অনেক প্রচলিত কথা শোনা যায়। তবে এটা সত্য যে, এই নেতার দেশজুড়ে ১৭টি জমকালো প্রাসাদ, ১০০টি বিলাসবহুল গাড়ির বহর এবং একটি ব্যক্তিগত জেট বিমান রয়েছে। এছাড়াও তার একটি ব্যক্তিগত দ্বীপ রয়েছে, যা আকারে হাওয়াই দ্বীপের সমান। তিনি সেন্ট লরেট সিগারেট খান, জনি ওয়াকার হুইস্কি পছন্দ করেন এবং একটি বিলাসবহুল মার্সিডিস বেঞ্জ ৬০০ সেডান-এ চড়ে ঘুরতে পছন্দ করেন। ঠিক একইভাবে পছন্দ করেন অন্যদের আঙুলের ইশারায় ঘোরাতে। পৃথিবী ঘুরছে। পৃথিবী কার হাতের মুঠোয় আসবে সময়ই বলে দেবে। তবে ক্ষমতার এই খেলায় ঘুরেফিরে আসছে কিম জং উনের নাম।

Share this post

scroll to top