কিম জং উন-এর যত নিষ্ঠুরতা

তিনি একটি দেশের ‘সর্বোচ্চ নেতা’, দলের প্রথম সম্পাদক, সভাপতিমণ্ডলী নিয়ন্ত্রণ কমিটির প্রধান, সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ অধিনায়ক এবং দেশটির প্রেসিডেন্ট। পাঠককে এই ফাঁকে জানিয়ে রাখি, প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য তাকে নির্বাচনে লড়াই করে জিতে আসতে হয়নি। এমনকি বাবার সবচেয়ে ছোট সন্তান হয়েও তিনি বড় ভাইকে টপকে এই দায়িত্ব পেয়েছেন। সাকুল্যে তার দুটি ডিগ্রি রয়েছে, একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানের ওপর, আরেকটি সেনা কর্মকর্তা হিসেবে সামরিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। মাত্র ২৭ বছর বয়সেই উত্তর কোরিয়ার প্রধান হয়ে তিনি এখন বিশ্বের আলোচিত (সমালোচিত) রাষ্ট্রনায়কদের একজন।

কিম জং উন বিশ্ববাসীর কাছে ইতোমধ্যেই একগুঁয়ে, চতুর এবং স্বৈরশাসক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। দেশবাসীর কাছে এর চেয়েও তার বড় পরিচয় ‘নিষ্ঠুর প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে। ২০১১ সালের আগস্টে কিম ক্ষমতায় এসেই সেনাপ্রধান রি ইয়ং গিলের উপর চড়াও হন। তারই নির্দেশে রি-এর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়। স্বাভাবিকভাবেই রি দোষী প্রমাণিত হন এবং তাকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়। এরপরই শুরু হয় সরকারি মহলে কিম-বিরোধীদের খুঁজে বের করার পালা। সরকারের একাধিক উচ্চপদস্থ আধিকারিককে দায়িত্ব থেকে শুধু সরিয়ে দেওয়াই নয়, পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দেন কিম। এ সময় তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো আনা হয়, সেগুলো কম হাস্যকর ছিলো না। যেমন শত্রুদেশ দক্ষিণ কোরিয়ার সোপ অপেরা দেখা। কিমের চেখে এটি দেশদ্রোহিতার শামিল এবং এর একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড! মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ক্ষেত্রেও কিমের নিষ্ঠুরতার জুড়ি মেলা ভার! যেমন অপরাধীকে কখনো ক্ষুধার্ত কুকুরের মুখে ঠেলে দেওয়া, কখনো কামানের তোপে, এমনকি সরাসরি গুলি করে হত্যা করার আদেশ দিতেও কুণ্ঠাবোধ করতেন না তিনি।

২০১৩ সালেও বিশ্ববাসী কিম জং উন-এর নিষ্ঠুরতার পরিচয় পেয়েছে। সে তার চাচা জ্যাং সং থিককে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়। তিনি ছিলেন কিমের ব্যক্তিগত সহকারী। কিন্তু হঠাৎ করেই উত্তর কোরিয়া সরকার দাবি করে, চাচা জ্যাং বিপ্লবের মাধ্যমে কিমকে অপসারণের পরিকল্পনা করছে। এমন অভিযোগের পর তাৎক্ষণিকভাবে জ্যাংকে অপসারণ করে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। ঘটনা এখানেই শেষ হতে পারত, কিন্তু জ্যাং-এর মৃত্যুতে তার স্ত্রী (কিমের চাচী) ব্যথিত ও মর্মাহত হন। এই খবর পৌঁছায় প্রেসিডেন্ট কিমের কানে। সঙ্গে সঙ্গে চাচীকেও দেওয়া হয় মৃত্যুদণ্ড।

২০১৩ সালে উত্তর কোরিয়া সরকার ১২ জন পপ তারকাকে আটক করে। তাদের অপরাধ, তারা যৌন মিলনের ভিডিও টেপ তৈরি করেছিল। যদিও তারা সমাজে দারুণ জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু কোনো অবদান ও খ্যাতি তাদের শাস্তি কমাতে পারেনি। তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়। এখানেই শেষ নয়, কিমের নির্দেশে তাদের নিকট আত্মীয়দেরকেও ধরে ধরে লেবার ক্যাম্পে প্রেরণ করা হয়।

উত্তর কোরিয়ায় কেউ অপরাধ করলে তিন প্রজন্মকে শাস্তি দেওয়া হয়। দাদা-দাদী, বাবা-মা ও সন্তানকে সেই অপরাধের শাস্তি মাথা পেতে নিতে হয়। কেউ দেশের এমন কঠোর, অবাস্তব আইন থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাইলে তাকেও ভোগ করতে হয় কঠিনতর শাস্তি! মৃত্যুদণ্ড সেখানে প্রায় ডালভাত!

পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল অনেক কিছুই ঘটিয়েছেন কিম জং উন। এমনই আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, পাঠ্যবইয়ে তার জীবনী যুক্ত করা। এটি একটি মাত্র অধ্যায় নয়, বইজুড়ে ‘বিস্ময়বালক’ কিম জং উনের মাহাত্ম্য। কীভাবে তিনি মাত্র তিন বছর বয়সে দক্ষ চালক হয়ে উঠেছিলেন, মাত্র নয় বছরে নৌ-প্রতিযোগিতায় জিতেছিলেন এসবের গুণগান সেদেশের শিশুদের অবশ্যপাঠ্য। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, উনের এই নতুন কৌশলের পেছনে উদ্দেশ্য হলো, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে প্রশ্নহীন আনুগত্য তৈরি করা।

উত্তর কোরিয়ার আইনে কোনো ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে সাবেক রাষ্ট্রনেতা কিম ইল-সাং এবং কিম জং-ইলের ছবি বাঁচানো জাতীয় কর্তব্য। রাষ্ট্রনেতাদের ছবি বাঁচাতে গিয়ে কেউ যদি জীবন খোয়ান, তবে দেশবাসীর চোখে তিনি ‘হিরো’। শুধু তাই নয়, প্রতিটি বাড়িতে এদের ছবি রাখাও বাধ্যতামূলক। এরা কিম জং উনের পূর্বপুরুষ।

আন্তর্জাতিক সংস্থা রিপোটার্স উইদাউট বর্ডার্স সর্বশেষ বিশ্বের ১৮০টি দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার যে সূচক প্রকাশ করেছে, তাতে উত্তর কোরিয়ার অবস্থান ১৮০তম। পরিস্থিতি সেখানে এতটাই ভয়াবহ যে কেউ দেশের বাইরের বা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম থেকে কিছু জানার চেষ্টা করলে তাকে জেলে যেতে হয়। মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, কালোবাজারির মাধ্যমে সেদেশে কিছু চীনা মোবাইল ফোন পাওয়া যায়। গোয়েন্দা সংস্থার নজরে পড়লে, ফোন ব্যবহারকারীকে ভীষণ হয়রানির মুখে পড়তে হয়।

তবে, ভাইকে হত্যার মধ্য দিয়ে কিম তার সব নিষ্ঠুরতাকে ছাড়িয়ে যান। বলাবাহুল্য এই হত্যাকাণ্ড শুধু ক্ষমতার চেয়ারটি নিরাপদ রাখার জন্য। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক খবরে বলা হয়, কিম জং উন তার সৎভাই কিম জং নামকে গুপ্তহত্যা করেছেন। এর মাধ্যমে উত্তর কোরিয়ায় কিম জং উনের শাসনের ‘নিষ্ঠুর ও অমানবিক’ ধরন প্রকাশ পেয়েছে বলেও মন্তব্য করা হয়। খবরে প্রকাশ, মালয়েশিয়ার সরকারের কাছে উত্তর কোরিয়ার শীর্ষ নেতা কিম জং উনের সৎভাই কিম জং নামের লাশ ফেরত চায় পিয়ংইয়ং। ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ার পর কিম জং নামের মৃত্যু হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়েন্দাদের সন্দেহ, উত্তর কোরিয়ার গুপ্তচরেরা কিমের নির্দেশে তাঁকে বিমানবন্দরেই বিষপ্রয়োগে হত্যা করেছে।

তথ্যসূত্র : ইন্ডিয়া টাইমস, রয়টার্স, বিবিসি, র‌্যাঙ্কার্স ডট কম।

Share this post

scroll to top