সদ্যই বিশ্বকাপ জেতা আর্জেন্টিনায় তখন আনন্দের জোয়ার। উঠতি তরুণদের স্বপ্ন ডিয়েগো ম্যারাডোনা হওয়ার। আর সেই স্বপ্নের পালে হাওয়া জোগাচ্ছিল আর্জেন্টাইন বাবা-মা’রা। ফুটবলের এমন জোয়ারের সময় ১৯৮৭ সালের আজকের দিনে আর্জেন্টিনার রোজারিওতে হোর্হে মেসি এবং সেলিয়া মারিয়া কিউকিত্তিনির ঘরে এলেন লিওনেল মেসি, দ্য গ্রেটেস্ট প্লেয়ার অফ দ্য ফুটবল।
ছোটকাল থেকে খুব চাপা স্বভাবের মেসি ছিলেন প্রচুর ঘরকুণো। মুখে তেমন কথাও বলতেন না। মেসির সতীর্থরা শুরুতে ধরেই নিয়েছিল, কথা বলতে পারতেন না মেসি। মুখ না চললেও পায়ের জাদুতে মেসি তাঁর সতীর্থ থেকে শুরু করে সবাইকে মোহিত করে রাখতেন। মেসির ফুটবল জাদুতে বিমোহিত হয়ে ২০০১ সালে বার্সেলোনা তাকে সাইন করিয়ে নেয়।
আর এরপর থেকে এক ইতিহাসের অধ্যায়ের সূচনা। ফুটবল মাঠে একের পর এক কীর্তি গড়ে নিজেকে নিয়ে গেছেন এমন উচ্চতায় স্বয়ং আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি ম্যারাডোনাও নতি স্বীকারে বাধ্য হয় মেসির সামনে। আজ এই ফুটবল জাদুকরের জন্মদিনে তাঁর কিছু রেকর্ড ও অজানা তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা।
লিওনেল মেসির পুরো নাম লুইস লিওনের আন্দ্রেস মেসি কিউকিত্তিনি। এই আর্জেন্টাইনের প্রিয় খাবার মিলানেসা নাপোলিতানা। মেসির খেলায় মুগ্ধ হয়ে স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশন এই তারকাকে স্পেনের হয়ে খেলার সরাসরি প্রস্তাব দেন। তবে মেসি এই প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। স্প্যানিশ লা লিগায় মেসি এত কীর্তি গড়েছেন এবং স্পেনের দর্শকদের এমনভাবে মোহিত করে রেখেছেন যে, স্পেনের শব্দভান্ডারে মেসির জন্য আলাদা একটা শব্দ যোগ করা হয়েছে। ‘ইনমেসিওনেট’ নামক সেই শব্দের অর্থ হচ্ছে, চিত্তাকর্ষক মেসি।
ফুটবল বিশ্বের অন্যতম শান্ত খেলোয়াড় হিসেবে বিবেচনা করা হয় মেসিকে। মাঠে অযাচিত ফাউল, বাজে আচরণ থেকে বিরত থাকেন তিনি। অথচ আর্জেন্টাইনদের হয়ে অভিষেক ম্যাচে ৪৪ সেকেন্ডের মাথায় রেফারি তাকে লাল কার্ড দেখিয়েছিলেন ফাউলের জন্য। ক্যারিয়ারে ৭০০ গোলের মাইলফলক থেকে আর ১ গোল দূরে থাকা মেসি তাঁর গোল উদযাপনের সময় দুই বাহু আকাশের দিকে তুলে ইশারা করে। আর এই উদযাপন তিনি করেন তাঁর দাদির জন্য। যিনি মেসির ১০ বছর বয়সে পরপারে পাড়ি জমান।
রেকর্ড বইতে মেসি
মেসি তাঁর ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় কাটিয়েছেন স্প্যানিশ লা লিগার দল বার্সেলোনায়। আর কাতালান ক্লাবটির হয়ে সম্ভব সন ধরনের রেকর্ড নিজের করে নিয়েছেন এই ক্ষুদে জাদুকর। লা লিগার ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোল এবং রেকর্ডের মালিক মেসি। লা লিগায় ৪৭৭ ম্যাচ খেলে ৪৪০ গোল করেছেন তিনি। ম্যাচপ্রতি গোল গড় .৯২। আর এই পথে মোট ৩৬টি হ্যাটট্রিক নিজের করে নিয়েছেন মেসি।
এক বর্ষিকাপঞ্জে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ডও মেসির দখলে। ২০১২ সালে মেসি ৯১ গোল করেন ক্লাব ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। পেছনে ফেলেন কিংবদন্তি ফুটবলার গার্ড মুলারকে। ১৯৭২ সালে এই জার্মান করেছিলেন ৮৫ গোল। মেসির ৯১ গোলের মধ্যে ৭৯টি ক্লাব ও ১২টি জাতীয় দলের হয়ে ছিল।
ফুটবল বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় কে? এই প্রশ্নে নানা তর্ক-বিতর্ক থাকলেও মেসির নাম নির্দ্বিধায় চলে আসে। তবে পরিসংখ্যানও মেসির পক্ষে কথা বলে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ফুটবলারের মর্যাদাকর ব্যালন ডি’অর পুরস্কার মেসি এই পর্যন্ত ৬ বার নিজের দখলে নিয়েছেন। এর মধ্যে ২০০৯ থেকে ২০১২ পর্যন্ত টানা চারবার পেয়েছেন এই পুরস্কার।
উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগেও জয়জয়কার অবস্থা মেসির। মেসি এই প্রতিযোগিতার গ্রুপ পর্বে সর্বোচ্চ ৬৮ গোল করেছেন। এমনকি শেষ ষোলোতেও তাঁর (২৯ গোল) চেয়ে বেশি গোল নেই কারো। এছাড়াও চ্যাম্পিয়ন লিগের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ১০ হ্যাটট্রিক করে রোনালদোর সঙ্গে শীর্ষে আছেন এই ফুটবলার।
ক্লাব ফুটবলে বার্সেলোনার হয়ে মোট ৩৪টি শিরোপা জিতেছেন মেসি। ক্লাব ফুটবলের ইতিহাসে যা কোনো নির্দিষ্ট ফুটবলারের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শিরোপা জয়। সামনে রয়েছেন কেবল সাবেক ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তারকা রায়ান গিগস (৩৬)। তবে সেটিও নিজের করে নেওয়া মেসির জন্য কেবল সময়ের ব্যাপার।
ক্লাব ফুটবলের সম্ভব সব শিরোপা জিতলেও আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে দুর্ভাগা মেসি। জিততে পারেননি কোনো মেজর শিরোপা। অধিনায়ক মেসি জাতীয় দলের হয়ে সর্বকালের সর্বোচ্চ ৭০ গোল দিলেও শিরোপা অর্জনের পথে সেটি হাতিয়ার হতে পারেনি। তবে সামনের কাতার বিশ্বকাপ কিংবা কোপা আমেরিকায় সেই আক্ষেপ ঘুচাতে পারেন কী মেসি, সেটিই এখন মেসি ভক্তদের কাছে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। ব্যক্তি মেসির কাছেও কী নয়?
তবে জাতীয় দলের শিরোপাই মেসির প্রতিভা, সামর্থ্যের প্রমাণ নয় কখনোই। দুই পায়ের জাদুতে গত ১৫ বছরের জন্য বিমোহিত করে রাখার দরুণ নিজের ৩৩ তম জন্মদিনে সমর্থকদের কাছ থেকে টুপি খোলা অভিনন্দন তো পাওনা হয়েই আছেন লিওনেল আন্দ্রেস মেসি।