বাংলাদেশ থেকে রফতানিকৃত ৯৭ শতাংশ পণ্যকেই শুল্কমুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে চীন। চীনা সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ। তবে দু’দেশের এ সম্পর্কের মাঝে নাক গলাতে শুরু করেছে ভারতীয় গণমাধ্যম। ভারত ইতোমধ্যে সীমান্ত বিরোধ নিয়ে চীনের হুংকার সামাল দিতে না পেরে বাংলাদেশের সাথে চীনের সম্পর্কে ফাটল ধরাতে নতুন কৌশল আবিষ্কার করতে চাচ্ছে ভারতীয় গণমাধ্যম। স্বাভাবিক চোখে যেন মেনেই নিতে পারছে না বাংলাদেশ-চীনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। ভারতীয় গণমাধ্যমের উস্কানিমূলক বিভিন্ন সংবাদে ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমকে ভাল চোখে দেখছে না। এসব উস্কানীমূলক সংবাদের পেছনে বড় কোন রহস্য থাকতে পারে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় উঠেছে। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম জি নিউজ এক সংবাদে শিরোনাম করে “ভারতকে চাপে ফেলতে ‘স্বল্পোন্নত’ বাংলাদেশকে ‘খয়রাতি‘ চিনের!” ভারতীয় আরেক সংবাদ মাধ্যম আনন্দ বাজার রিখেছে, বাণিজ্যিক লগ্নি আর খয়রাতির টাকা ছড়িয়ে বাংলাদেশকে পাশে পাওয়ার চেষ্টা নতুন নয় চিনের। বাংলাদেশকে রীতিমতো ভিক্ষুক হিসেবে তাদের সংবাদে উপস্থাপন করেছে। তবে এ ধরণের নিম্নমানের শব্দ ব্যবহারে মূলত ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের নিরপেক্ষতা ও উস্কানী স্পষ্ট। বাংলাদেশ কি তাহলে খয়রাতি মানে ভিক্ষা করেই চলে! তবে ভারতীয় গণমাধ্যমকে আরো ভদ্র শব্দ ব্যবহারে আহবান জানিয়েছে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ। ভারত কী একবার ভেবে দেখেছে যে, বাংলাদেশ ছাড়া তাদের এখন বন্ধু বলতে কেউ নেই! তার চতুর্দিকে এখন শত্রু, শুধু বাংলাদেশ ছাড়া। আর সেই বাংলাদেশ নিয়ে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের নোংরা সংবাদ পরিবেশন মানায় না।
স্বাধীনতার আগে সকল সুযোগ সুবিধা যেত পশ্চিম পাকিস্তানে আর শোষণ হতো পূর্ব পাকিস্তান, যত ক্ষতিকর প্রকল্প হতো পূর্ব পাকিস্তানে। তেমনিভাবে বাংলাদেশে যত ক্ষতিকর প্রকল্প তা যৌথভাবে করছে ভারত। সেটা করতে যে পণ্য ব্যবহৃত হবে তা হতে হবে ভারতীয়। এবং সমস্ত সুযোগ-সুবিধাও নিয়ে যাবে ভারত। এই জায়গায় মনে হয় চিন্তা-ভাবনার সময় এসেছে। এ পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে যে কয়টা চুক্তি হয়েছে, সবগুলোই ভারতের জন্য খুব সুবিধাজনক হয়েছে। বাংলাদেশের বিবেচনায়, বাংলাদেশের পক্ষে দর কষাকষির ভিত্তিতে এখনো বাংলাদেশ তাদের সঙ্গে কোনো চুক্তি হয়নি। অথচ বাংলাদেশে চাকরি করছে ‘৫ লাখ’ ভারতীয়, যাদের অধিকাংশই অবৈধ। বাংলাদেশ এসব ভারতীয়দের ব্যাপারে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি শুধু বন্ধুত্বের খাতিরে। আর সেই ভারত বাংলাদেশকে ভিক্ষুক বলে উপহাস করে!
কিছু বিষয় লক্ষ্য না করলেই নয়। সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল ভারত সম্পর্কে বলতে গিয়ে জানিয়েছিলেন, রামপালের প্রকল্প নির্মাতা ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসি তাদের নিজ দেশ ভারতে সকল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থগিত করেছিল। তারা তাদের কার্বন তৈরির দায় কমাতে চায়। কিন্তু তার বদলে তারা গুজরাটে বিশ্বের বৃহত্তম সৌর শক্তি পার্ক স্থাপনের জন্য ২৫ হাজার কোপি রুপি বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেছিল। তারা কয়েকটি রাজ্যের কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র অর্ধদিবস বন্ধ রাখার কথাও জানিয়েছিল। অথচ ওই একই প্রতিষ্ঠান প্রবল গণআপত্তির মুখেও বাংলাদেশে কয়লা বিদ্যুৎ তৈরিতে পিছপা হয়নি। এটি নিঃসন্দেহে একটি দায়িত্বজ্ঞানহীন ডাবল স্ট্যান্ডার্ড আচরণ।
ভারতের ত্রিপুরার মানুষের খাবার পানির সংকট মেটাতে বাংলাদেশের ফেনি নদী থেকে ১.৮২ কিউসেক পানি নিতে ভারতকে অনুমতি দিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং বলেছেন, ‘‘কেউ যদি পানি পান করতে চায়, আর তা যদি না দিই কেমন দেখায়?” প্রতিবেশীর প্রতি বাংলাদেশের এই মহানুভবতা নিঃসন্দেহে প্রচলিত দেনা-পাওনার হিসেবের উর্ধ্বে। কঠোর বাস্তববাদিরা হয়তো বলবেন, ‘গিভ এন্ড টেক’-এর এই দুনিয়ায় বাংলাদেশ ভারতকে দেয়ার ক্ষেত্রে যতটা উদার নেয়ার ক্ষেত্রে ততটা পারদর্শী নয়। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশকে নিজেদের বাজারের জায়গা বানিয়েছে ভারত। ফেনীর বিলোনিয়া স্থলবন্দরের মাধ্যমে বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দেয়ায় দ্বি-মুখী বাণিজ্যের পরিবর্তে একমুখী বাণিজ্যের মাধ্যমে একতরফা সুবিধা লুটে নিচ্ছে ভারত।
সুতরাং, ভাল সম্পর্ক কখনোই একপাক্ষিক হতে পারে না, সম্পর্কের ভিত্তি মজবুত করতে হলে ‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে’- এই আপ্ত বাক্যের চর্চা ও প্রয়োগ করতে হয়। এই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে দরকষাকষিতে পিছিয়ে পড়লে চলবে না। ভারত যেভাবে নিজেদের জাতীয় স্বার্থ দেখে চলছে, বাংলাদেশকেও সেভাবেই নিজের স্বার্থ বুঝে নিতে হবে। বাংলাদেশের জনমানুষের মনে একটু একটু করে ভারতের কর্তৃত্ববাদি, সুবিধাবাদি বড় ভাই সুলভ যে ইমেজ গড়ে উঠেছে তার পরিবর্তন করতে হলে, ভারতের একক সিদ্ধান্তের ফলে প্রত্যক্ষভাবে গণমানুষ যেসব সমস্যা ভোগ করছে তা দূর করতে হবে। হিসাব নিকাষ হতে হবে ন্যায্যতার ভিত্তিতে, সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে, আন্তরিকতার সঙ্গে।
বরংচ ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে কিছু বিষয় শিখতে পারে। যেমন:-
ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জে কিষাণ রেড্ডি বলেছিলেন, ভারত বাংলাদেশের জনগণকে নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রস্তাব করলে অর্ধেক বাংলাদেশ জনমানব শূন্য হয়ে যাবে। আর এবার তার এই বক্তব্যের কঠোর জবাব দিয়েছিলেন দেশটির প্রখ্যাত কলামিস্ট স্বাতি নারায়ণ।
ভারতের প্রখ্যাত কলামিস্ট স্বাতি নারায়ণ ভারতীয় মন্ত্রীর চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, বাংলাদেশ এখন ভারতের চেয়ে বেশ কয়েকটি দিক দিয়ে উন্নত। পিছিয়ে নেই বাংলাদেশ। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে এক সম্পাদকীয়তে তিনি লিখেন, আশির দশকে দক্ষিণ এশিয়ায় সবেচেয়ে বেশি বাঁচতেন ভারতের মানুষেরা। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশি নারীরা ভারতের থেকে চার বছর বেশি বেঁচে থাকার প্রত্যাশা করতে পারে। এই সাফল্যের সূত্রটি খুবই সহজ। তিনি লিখেন, ২০০৯ সাল থেকে প্রতি তিনটি গ্রামে একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক তৈরি করেছে বাংলাদেশ। এছাড়াও চার দশক ধরে সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়িবাড়ি গিয়ে নারীদের কাছে ওষুধ সরবরাহ করেছেন এবং পরিবার পরিকল্পনা করতে সহায়তা করেছেন।
তিনি লিখেন, শিক্ষার ক্ষেত্রে, ভারতের জনসংখ্যা তুলনামূলক লভ্যাংশে থাকলেও যুব শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি প্রান্তিক সুবিধা অর্জন করেছে। বাংলাদেশের মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণ করছে। সবচেয়ে বড় কথা, পঞ্চগড় জেলায় আমার করা এক জরিপে দেখেছি, ভারতের শিশুদের থেকে বাংলাদেশের শিশুদের পড়ার দক্ষতা সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের ৪৪টি বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের অনুপস্থিতি নেই বললেই চলে। এছাড়াও শিক্ষাবর্ষ শুরু থেকেই বাংলাদেশ সরকার সরকারি, বেসরকারি (এনজিও) এবং মাদরাসাগুলোতে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করে।
তিনি আরো লেখেন, পুষ্টিগ্রহণের দিক থেকেও বাংলাদেশ এগিয়ে। জনসংখ্যাতাত্ত্বিক স্বাস্থ্য জরিপ অনুযায়ী, ভারতে সঠিক ওজনের থেকেও কম ওজন নিয়ে বাস করে ৩৬ শতাংশ শিশু। অন্যদিকে, বাংলাদেশে সঠিক ওজনের থেকেও কম ওজন নিয়ে বাস করে ৩০ শতাংশ শিশু। একইভাবে, ভারতীয় শিশুদের একটি বৃহত্তর অংশ সঠিকভাবে বেড়ে ওঠছে না।
স্বাতি নারায়ণ লিখেন, বাংলাদেশে কমপক্ষে ৮০ শতাংশ নাগরিকদের বাড়িতে টয়লেট রয়েছে। আমার এক জরিপে ২০১৬ সালের মধ্যে ৯৬ শতাংশ বাড়িতে এবং ৮০ শতাংশ বিদ্যালয়ের সঠিক পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা দেখতে পাই। স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সাধারণত ইসলামিক জোর দাবি ছাড়াও স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো দরিদ্র পরিবারগুলোতে সিমেন্টের রিং বিনামূল্যে সরবরাহ করছে। তারা নিয়মিতভাবে আলোচনা, মসজিদ, গণমাধ্যম এবং স্কুলের মাধ্যমে স্বাস্থ্য সচেতনতার বার্তাও ছড়িয়ে দিচ্ছে।
এর বাইরে বাংলাদেশের নারীদের কাজ নিয়েও তিনি তুলনা করেন। তিনি লিখেন, ২০০৬ সালের বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় ‘শিক্ষামূলক হাইপোগামি’র ক্রমবর্ধমান প্রবণতা পাওয়া গেছে। এদিকে, ভারতের নিচে নামছে। তিনি লেখেন, বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক নারী জনশক্তি রয়েছে। তৈরি পোশাক খাত ছাড়াও কয়েক হাজার গ্রামীণ নারী কৃষি কাজ, চা কারখানা, পাটকল, হাঁস-মুরগি উৎপাদন এবং দুগ্ধ শিল্পে কাজ করেন।
স্বাতি নারায়ণ লেখেন, ভারতে ৪৫ বছর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি বেকার। আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ডুবছেই। তাই ভারত সরকারের মন্ত্রীদের উচিত নিজেদের লাগাম নিজেরাই টেনে ধরা। তিনি লেখেন, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের আলোকে অবৈধ অভিবাসীর মিথ্যা ছায়ামূর্তি তৈরি করে আমাদের প্রতিবেশীদের মধ্যে ইসলামবিদ্বেষী ক্ষোভ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া আর কিছুই নয়। বরং ভারত সরকারের পক্ষে ‘সোনার বাংলা’ থেকে নাগরিকদের জীবনযাত্রার উন্নতি কিভাবে করতে হয় তা শেখা বুদ্ধিমানের কাজই হবে।
সুতরাং, ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের উচিত বাংলাদেশ থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে উস্কানীমূলক শব্দ প্রত্যাহার করা।
লেখক : সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী