ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান হওয়ায় ভোট ও নির্বাচন ইসলামিক বিষয় এবং ইবাদতের অংশ। ভোট দেয়া দেশের প্রতিটি যোগ্য নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব। ভোট ব্যক্তির নিজস্ব মতামত কিংবা জনমত প্রতিফলনের একটি গণতান্ত্রিক মাধ্যম ও পদ্ধতিবিশেষ। কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের লক্ষ্যে ভোটের প্রয়োজন হয়। রাজনীতিতে ভোট এমন একটি পদ্ধতি, যার মাধ্যমে একজন প্রার্থী গণতান্ত্রিক পন্থায় কোনো না কোনো পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন।
ভোটের সঙ্গা : ভোট প্রধানত মতামত প্রকাশের একটি গণতান্ত্রিক বা প্রজাতান্ত্রিক মাধ্যম বা পদ্ধতি। কোনো সভা কিংবা নির্বাচনে সিদ্ধান্ত গ্রহণের লক্ষ্যে ব্যক্তির নিজস্ব মত কিংবা জনমত যাচাইয়ের প্রয়োজনে ভোট একটি বহুল প্রচলিত মাধ্যম। ভিন্নমতে এটাকে জনমতের প্রতিফলনও বলা চলে।
ইসলামের দৃষ্টিতে ভোটের চারটি প্রয়োগিক অর্থ রয়েছে : ১. সাক্ষ্য দেয়া; ২. প্রতিনিধি নিযুক্ত করা; ৩. সুপারিশ করা; ৪. আমানত রাখা।
সাক্ষ্য : দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নতি, অগ্রগতি ও কল্যাণের লক্ষ্যে নিজের সমর্থন ও সাক্ষ্য দেয়ার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা দলকে ভোট দেয়ার মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মনোনীত করা হয়। প্রার্থীকে তার প্রার্থিত পদে ভোট দেয়ার অর্থ হলো, ভোটার এই মর্মে সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, এই প্রার্থী ওই পদের জন্য সার্বিক বিবেচনায় সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি। বাস্তবে যদি তিনি ওই পদের জন্য যোগ্য না হন, তা হলে ভোটার মিথ্যা সাক্ষ্যের দোষে দোষী হবেন। ইসলামের দৃষ্টিতে সত্য ও ইনসাফের সাথে সাক্ষ্যদান ওয়াজিব এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া হারাম। এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা ন্যায়বিচারে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত থাকবে আল্লাহর সাক্ষীস্বরূপ; যদিও তা তোমাদের নিজেদের অথবা বাবা-মা এবং আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে হয়’ (সূরা নিসা : ১৩৫)। আল্লাহ আরো বলেন, ‘(রহমানের বান্দা তারাই) যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না এবং অসার ক্রিয়াকলাপের সম্মুখীন হলে স্বীয় মর্যাদার সাথে তা পরিহার করে চলে’ (সূরা ফুরকান : ৭২)।
সহিহ বুখারির একটি বর্ণনায় হজরত আবুবকর রা: বলেন যে, মহানবী সা: একদা এক জায়গায় হেলান দিয়ে বসা অবস্থায় তিন তিনবার সাহাবিদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে কবিরা গুনাহের মধ্যে বড় কবিরা গুনাহের কথা বলব?’ সাহাবিরা হ্যাঁ সূচক জবাব দিলে তিনি বললেন, ‘আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা, মা-বাবার অবাধ্যতা (এ দু’টির কথা বলার পর তিনি সোজা হয়ে বসলেন) এবং বললেন, ‘শুনে নাও! মিথ্যা সাক্ষ্য অনেক বড় কবিরা গুনাহ’ (সহিহ বুখারি, মুসলিম)। উল্লিখিত আয়াত ও হাদিস থেকে দু’টি বিষয় স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়Ñ
ক) সর্বাবস্থায় সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে থাকতে হবে
খ) সত্য সাক্ষ্য এবং কথা বলতে পক্ষপাতিত্ব করা যাবে না।
প্রতিনিধি : সমাজ কিংবা রাষ্ট্র পরিচালনায় যোগ্য নেতা নির্বাচন প্রত্যেক পরিণত নাগরিকের সামাজিক অধিকার ও জাতীয় দায়িত্ব। দলীয় সঙ্কীর্ণতা, স্বজনপ্রীতি, বৈষয়িক ব্যক্তিস্বার্থের লোভ বা কোনোরূপ প্রভাবের কাছে নতি স্বীকার না করে সৎ, যোগ্য ও ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিকে প্রতিনিধি নিযুক্ত করার মাধ্যমে এ অধিকার প্রয়োগ ও পালন করতে হবে। কিন্তু এর বদলে অর্থ, প্রতাপ বা বংশীয় সম্পর্কে প্রভাবিত হয়ে কেউ যদি অযোগ্য প্রার্থীকে ভোট দেন, তা হলে হাদিসের ভাষায় তিনি খিয়ানতকারী (অপব্যবহারকারী) সাব্যস্ত হবেন। মহানবী সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলিমদের পক্ষ থেকে কোনো দায়িত্বে নিযুক্ত হয়, তারপর সে তাদের ওপর এমন কাউকে কোনো কাজে কর্মকর্তা নিযুক্ত করে, যার চেয়ে চরিত্রে ও কুরআন-হাদিসের জ্ঞানে অধিকতর যোগ্য ব্যক্তি আছে বলে সে জানে, তবে সে অবশ্যই আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা: এবং মুসলিম সমাজের অধিকারের খেয়ানত করল’ (তাবারানি)। তাই কোনো অযোগ্য লোককে প্রতিনিধিত্বের জন্য দেয়া এবং তাকে জয়যুক্ত করা হলে পুরো জাতির হক নষ্ট করার গুনাহ হবে।
সুপারিশ : ভোটদাতা প্রতিনিধি নির্বাচনের উদ্দেশ্যে কাউকে ভোট দেয়ার অর্থ হলো তিনি এই মর্মে সুপারিশ করছেন যে, ওই প্রার্থীকে প্রতিনিধি মনোনয়ন করা হোক। সুতরাং শরিয়তের দৃষ্টিতে ভোট দেয়া কোনো পদের জন্য কোনো ব্যক্তির পক্ষে সুপারিশ করার নামান্তর।
সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিকে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করা হলে তিনি যেসব ভালো কাজ করবেন, ভোটদাতা তার উত্তম প্রতিদান লাভ করবেন। পক্ষান্তরে ওই প্রার্থী যদি অযোগ্য হয়ে থাকেন এবং ভোটারের ভোটের কারণে জয়ী হন, অতঃপর কোনো অন্যায় কাজ করেন; তা হলে ভোটারও পরোক্ষভাবে গোনাহে শরিক থাকবেন। আল্লাহ বলেন, কেউ কোনো ভালো কাজের সুপারিশ করলে তাতে তার অংশ থাকবে এবং কেউ কোনো মন্দ কাজের সুপারিশ করলে তাতে তার অংশ থাকবে’ (সূরা নিসা : ৮৫)।
আমানত : ভোট ব্যক্তির কাছে গচ্ছিত একটি গুরুত্বপূর্ণ আমানত। সৎ, যোগ্য ও ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিকে ভোট দিলে এ আমানতের সদ্ব্যবহার করা হয়, আর অযোগ্য ও ধর্মবিমুখ ব্যক্তিকে ভোট দিলে আমানতের খেয়ানত করা হয়। অধিকন্তু ভোটের আমানতের খেয়ানত ব্যক্তিগত খেয়ানতের চেয়ে গুরুতর, কেননা এর ফলে অসংখ্য মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শরিয়তের দৃষ্টিতে আমানত যথাস্থানে প্রত্যর্পণ ওয়াজিব এবং এর অন্যথা কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন আমানত তার হকদারকে প্রত্যর্পণ করতে’ (সূরা নিসা : ৫৮)।
কাকে ভোট দেবো : যারা ভোট প্রয়োগ করেন তাদের ভোটার বলা হয়। সে হিসাবে বলা চলে, জনপ্রতিনিধিদের নিয়োগকর্তা ভোটাররা। ভোট দেয়া শুধু আবেগ বা দলীয় বিষয় নয়, বরং এটি একটি ধর্মীয় বিষয়। সুতরাং জেনেশোনে অসৎ, অযোগ্য ও দুর্নীতিপরায়ণ প্রার্থীকে ভোট দেয়া ইসলামসম্মত নয়। চিন্তাভাবনা করে ভোট দিতে হবে। দলীয় আবেগ, আত্মীয় বা প্রতিবেশী হওয়া ভোট পাওয়ার যোগ্যতার মাপকাঠি হতে পারে না। মূলত ভোট পাওয়ার যোগ্য ওই ব্যক্তিই হবেন, যিনি ইসলামকে ভালোবাসবেন। যার দ্বারা দেশের সম্পদ লুণ্ঠিত হবে না, সমাজে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়বে না, সংখ্যালঘুদের ক্ষতিসাধন হবে না।
নির্বাচন প্রক্রিয়া কেমন হওয়া উচিত : নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য ব্যক্তির সততা, যোগ্যতা, আল্লাহ ভীতি, ইমান, জ্ঞান, আমল, চারিত্রিক গুণাবলিকে প্রাধান্য দিয়েছে ইসলাম। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে নির্বাচন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হওয়া যেমন প্রয়োজন, প্রার্থী বা নির্বাচিত ব্যক্তিও তেমন সৎ, যোগ্য, জ্ঞানী, চরিত্রবান, আল্লাহ ভীরু, আমানতদার, ন্যায়পরায়ণ, দেশপ্রেমিক, মানবদরদি ও দায়িত্বানুভূতি সম্পন্ন হওয়া তার চেয়ে আরো বেশি প্রয়োজন। তাই জাতীয় কিংবা স্থানীয় নির্বাচনে সৎ ও যোগ্য প্রার্থী দেখে ভোট দিতে হবে। যারা ভোটারদের মিথ্যা কথা বলে লোভ-লালসা দিয়ে প্রলুব্ধ করে, নির্বাচনী বৈতারণী পার হতে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ও প্রতারণার আশ্রয় নেয়, অন্যায় ও অবৈধ কার্যক্রমে লিপ্ত হয়, ভোট ক্রয়-বিক্রয় করে, জাল ভোট প্রদান করে; তাদের বর্জন করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ভোটের বিষয়টি শুধু পার্থিব নয়, পরকালেও এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে। মহানবী সা: বলেছেন, ‘প্রত্যেক কাজের সফলতা, ব্যর্থতা, সুফল ও কুফল ব্যক্তির নিয়তের ওপর নির্ভর করে’ (সহিহ বুখারি)।
শেষ কথা : চিন্তা-চেতনার বাস্তবায়ন মানুষ দ্বারা হয় বলেই সে আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব। অসংখ্য ভোটপ্রার্থীর মধ্যে আমাদের তাকেই জয়ী করা উচিত, যিনি কথা ও কাজে এক, যিনি দেশকে এবং দেশের লোককে ভালোবাসেন, যিনি ইসলামকে ভালোবাসেন, সর্বোপরি যিনি তার নির্বাচনী এলাকার উন্নতির জন্য কাজ করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেবেন এবং তা বাস্তবায়নে সচেষ্ট হবেন।
লেখক : গবেষক