ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেকে আলো ছড়াতে না পারা শাহরিয়ার নাফীস নিজের দ্বিতীয় ম্যাচে পেয়েছিলেন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়াকে। অদমনীয় সেই বোলিং অ্যাটাকে কে ছিল না?
সর্বকালের সেরা গ্লেন ম্যাকগ্রার সঙ্গী জেসন গিলেস্পি ও সবচেয়ে দ্রুতগতির পেসার ব্রেট লি। সাথে আগ্রাসী শেন ওয়াটসন। চতুষ্টয়ের পেস আক্রমণ সাথে চায়নাম্যান ব্রড হগ। বলার অপেক্ষা রাখে না যে কোনও ব্যাটিং অর্ডারের জন্যই তারা ছিলেন হুমকি।
অনভিজ্ঞ নাফীস সেদিন কঠিন পরীক্ষা দিয়েছিলেন ২২ গজে। তাদের সামলে খেলেছেন ৪৭ রানের ধ্রুপদী ইনিংস। কিভাবে ব্রেট লি, গ্লেন ম্যাকগ্রা ও জেসন গিলেস্পিদের সামলেছিলেন নাফীস। স্মরণীয় সেই দ্বৈরথের গল্প তার মুখ থেকেই শোনা যাক।
‘বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে আমার অভিষেক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে নটিংহ্যামে। ওই ম্যাচটিতে খুব একটা ভালো করতে পারিনি, মাত্র ১০ রান করেছিলাম। আমরা বড় ব্যবধানে ম্যাচটি হেরে যাই। পরের ম্যাচ খেলার জন্য চলে যাই ম্যানচেস্টারে।আমাদের প্রতিপক্ষ ছিল অস্ট্রেলিয়া।’
‘হোটেলে চেকিং করার পর আমাদের কোচ ডেভ হোয়াটমোর প্রত্যেক খেলোয়াড়ের সাথে ব্যক্তিগতভাবে মিটিং করে। আমরা কিভাবে খেলবো, আমাদের কৌশল কি হবে সেসব নিয়ে কথা হয়েছিল। কোচ আমাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলেছিলেন, তুমি প্রথম ম্যাচ ভালো করতে পারোনি, কোনও সমস্যা নেই। সামনে আমাদের তিনটি ম্যাচ আছে। সেগুলিতে তুমি নিশ্চিন্তে খেল। বাদ পড়ার কোনও চিন্তা করবে না। আমরা তোমার উপর বিশ্বাস রাখছি। তুমি শুধু খেলে যাও।’
‘অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খেলা। আমাদের সঙ্গে খেলা এর আগের ম্যাচেই আমরা ওদের হারিয়েছি। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য অস্ট্রেলিয়া তাঁতিয়ে ছিল। আমরা অনুশীলন করলাম আগের দিন। ম্যাচের দিন সকালে ওয়ার্মআপ করলাম। ওয়ার্মআপের সময় যেটা হয়েছিল, আমি চিন্তায় প্রচণ্ড হাঁটাহাঁটি করছিলাম। আমার ভেতরটা খালি হয়ে আসছিল। কিভাবে খেলব…এরকম দলের বিপক্ষে। আবার শেষ ম্যাচ ভালো খেলিনি। প্রচণ্ড নার্ভাস ছিলাম।’
‘প্যাড আপ করলাম। আমার মনে আছে আমি সকালে কিছু খেতে পারিনি। কিভাবে খেলব এই বোলিং অ্যাটাকের বিপক্ষে; ম্যাকগ্রা, ব্রেট লি, জেসন গিলেস্পি। নার্ভাসনেস নিয়ে আমি আর জাভেদ ভাই প্রস্তুত হলাম। প্রথম বল খেলি, না দ্বিতীয় বল খেলি সেটা ব্যাপার না আমি আমার সঙ্গীকে মাঠে আগে যেতে দেই। উনি এগিয়ে গেলেন। আমি উনার পেছনে পেছনে যাচ্ছি। আমার পুরো ভেতরটা একদম খালি হয়ে যাচ্ছিল। এতো ভয়, এতো নার্ভাসনেস সেটা এর আগে আমি অন্য কোনও ম্যাচে পাইনি।’
‘ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্রাফোর্ড মাঠ, কানায় কানায় বাংলাদেশের দর্শকে পূর্ণ। ইংল্যান্ডে খেলার একটা বিশেষত্ব হচ্ছে, বাংলাদেশ যখন ইংল্যান্ডে যায় বাংলাদেশের সমর্থকদের দিয়ে মাঠ ভরে যায়। তারা প্রচণ্ড উল্লাস করছিলেন। ওই মাঠের ড্রেসিংরুম এমন ছিল যে, আপনাকে দর্শকদের মাঝ দিয়ে হেঁটে মাঠে নামতে হবে। আমি যখন মাঠে যাওয়া শুরু করি তখন বাংলাদেশের দর্শকদের আনন্দ, চিৎকারে আমার ভয় সব দূর হয়ে গেল।’
‘জাভেদ ভাই প্রথম বল খেললেন, পরে আমি গার্ড নিলাম। প্রথম বল খেলতে যাচ্ছি ব্রেট লি’র। টিভিতে আগে খেলা দেখিছি। বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির বোলার। সব বল ঘণ্টায় ৯০/মাইলের বেশি করে। এর আগে এতো জোরে বল খেলার অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। ভয় পাচ্ছিলাম খেলতে পারব কি না? বল আসলে দেখা যাবে কি না? এতো জোরে বল তো এর আগে কখনো খেলিনি।’
‘প্রথম বল খেলার পর বোলারের দিকে না তাকিয়ে, বল কোথায় গেছে সেদিকে না তাকিয়ে বড় স্ক্রিনের দিকে তাকালাম। দেখি বলের গতি ওই ৯০/মাইল। তখন বুঝতে পারলাম বল তো দেখতে পারছি, খেলতে পারছি। ইনশাআল্লাহ খেলতে পারব। এরপর ভয় দূর হয়ে গেল। পরের বল শর্ট ছিল। হাল্কা গ্লাইড করে থার্ড ম্যানে পাঠিয়ে এক রান নিলাম। রানের খাতা খুললাম। এভাবেই আমার ইনিংসটি শুরু হয়।’
‘পরের ওভার আসেন ম্যাকগ্রা। একদম ছোটবেলা থেকে ম্যাকগ্রার বোলিং দেখেছি। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ পেসার। ওয়ার্ল্ড ক্রিকেটের অন্যতম সেরা পেসার। হয়তো পেস ব্রেটলির মতো ছিল না। কিন্তু একদম নিখুঁত বোলার। তাকেও সাহস করে খেলে ফেললাম। একটা বল খেললাম, দুইটা বল খেললাম। একটি সিঙ্গেল নিলাম। এভাবে আস্তে আস্তে কিছুটা আত্মবিশ্বাস বিল্ড আপ করলাম।’
‘ওই সময়ে আমাদের দুইটা উইকেট পড়ে গিয়েছে। আমাদের অবস্থা খুব একটা ভালো না। দুই উইকেট পড়ে যাওয়ার পর আসলো আশরাফুল। আমরা ছোটবেলায় ওয়াহিদ স্যারের কাছে একসঙ্গে কোচিং করেছি। আমাদের মধ্যে একটা ভালো বোঝাপড়া ছিল। দুইজন দুইজনের সঙ্গে কথা বলা শুরু করলাম। এর আগের ম্যাচে আশরাফুল ৯৪ রান করেছিল ৫২ বলে। তার আগের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই ১০০। আত্মবিশ্বাস ভরা। ও আমাকে নিশ্চয়তা দেয় যে খেলে যা। এভাবে একরান, দুইরান করে ইনিংসটি এগিয়ে যেতে থাকে।’
‘সুনির্দিষ্ট করে ম্যাকগ্রার একটি ওভার মনে থাকবে আমার। ওই এক ওভারে আমি ১০ রান নিয়েছিলাম। প্রথমে একটি চার মেরেছিলাম ফ্লিক করে। স্কয়ার লেগ দিয়ে চার হয়েছিল। পরের বলটি গ্লান্স করেছিলাম ফাইন লেগ দিয়ে চার হয়েছিল। ওই ওভারে আরেকটি গ্লান্স করে ফাইন লেগে পাঠিয়ে ২ রান নেই। ওই ওভারে ১০ রান নেওয়ায় ওই ওভারটি সারাজীবন মনে থাকবে।’
‘ব্রেট লি ও ম্যাকগ্রাকে খেলার পর গিলেস্পি আসে। ওর গতি ম্যাকগ্রার চেয়ে বেশি কিন্তু ব্রেট লির মতো না। তখন কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিলাম। প্রথম বলেই মনে হয় থার্ড ম্যান অঞ্চল দিয়ে চার মারি। এভাবেই খেলতে খেলতে ওই ম্যাচের সেরা শটটা পেয়ে যাই। কভার ড্রাইভ করেছিলাম গিলেস্পিকে। দারুণ শটে চার হয়েছিল। ম্যাচে সেটা ছিল আমার ব্যক্তিগত পছন্দের সেরা শট।’
‘এভাবে একরান, দুই রান করতে করতে ইনিংস বড় করি। শেন ওয়াটসনও বোলিংয়ে আসে। ও খুব আক্রমণাত্মক বোলার ছিল। বাউন্সার দিচ্ছিল। সেগুলি ছেড়ে দিচ্ছি। ওকেও একটা ফ্লিক করে চার মারি। এভাবে আমার আর আশরাফুলের ইনিংসটি বড় হতে থাকে।’
‘এরপর আসলো ব্র্যাড হগ। ওর প্রথম বল ডিফেন্স করে মিস করেছিলাম। পরের বলে ব্যাটের কানায় লেগে চার হয়েছিল। এভাবে আরও এক রান, দুই রান নিলাম। এভাবে খেলে যেতে যেতেই দলের অবস্থান এবং আমার ব্যক্তিগত রান একটা ভালো জায়গায় চলে এসেছিল।’
‘অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস আসলো। মনে হলো এতো ভালো ভালো বোলার খেলেছি, ওকে কেন-ই বা খেলতে পারব না। একটি সিঙ্গেল নিলাম। ততক্ষণে আমার রান ৪৭ এ পৌঁছে গেছে। ৫৬ বলে ৪৭ রান। এরকম একটি পজিশনে থেকে মনে হল, এখন একটু হাত খুলে খেলা যায়। ওইটাই আসলে আমার কাল হয়ে দাঁড়াল।’
‘বল না দেখে আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে বল অফস্ট্যাম্পে আসলে সুইপ করবো। ওভাবেই পজিশন নিয়ে গিয়েছিলাম। সাইমন্ডস খুব লেটে বল ছাড়ে এবং পেস ও অফস্পিন দুটাই করত পারে। যে বলে আউট হই সেটা একবারে লেটে ছেড়েছিল, আবার ইয়র্কারও ছিল। আমি আগের থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, আমি সুইপ খেলতে যাবো। আমি বল মিস করি। বল অফস্ট্যাম্পে আঘাত করে। ৪৭ রানে আমি আউট হই।’
‘আশরাফুলের সাথে আমার ৯০ রানের জুটি। বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে ছিল। আমাদের রান রেট ভালো ছিল। ওই আউটের পর সিদ্ধান্ত নেই কখনো আর আগে চিন্তা করে কোনও শট খেলবো না এবং যদি কোনও দিন এরকম ৫০ বা মাইলফলকের কাছাকাছি আসি তাহলে একটু সাবধানী হয়ে খেলবো। পরের পরের ম্যাচটি আবার অস্ট্রেলিয়ার সাথে। ওই ম্যাচে কিন্তু পঞ্চাশোর্ধ ইনিংস (৭৫) খেলতে পেরেছিলাম।’