ময়মনসিংহ জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পুলিশ অজ্ঞাত গার্মেন্টকর্মী হত্যার পর বিবস্ত্র লাশ ফেলে খুনি পালিয়ে যাওয়ার ৪৮ ঘন্টার মধ্যে হত্যার রহস্য উদঘাটন ও পরিচয় সনাক্তকরণ ও খুনিকে গ্রেফতার করেছে। তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় খুনি রাজাবালিকে তার নিজবাড়ি ফুলবাড়িয়ার শ্রীপুর গ্রাম থেকে শুক্রবার (বৃহস্পতিবার দিবাগত) রাতে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃত রাজাবালি ডিবি পুলিশ ও আদালতের কাছে হত্যাকান্ডের দায় স্বীকার করেছে।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, গত ১০ জুন ফুলবাড়িয়ার শ্রীপুর গ্রামের একটি কচুক্ষেতে অজ্ঞাত এক মহিলার বিবস্র (৩০) লাশ স্থানীয়রা দেখতে পায়। খবর পেয়ে থানা পুলিশ, ডিবি, সিআইডি, পিবিআইসহ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) জয়িতা শিল্পী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। লাশ অজ্ঞাত, খুনিও অজ্ঞাত। এরপরও আঘাতের চিহৃ দেখে প্রাথমিকভাবে পুলিশ ধারণা করে নির্মমভাবে ঐ নারীকে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়েছে। খবর পেয়ে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আহমার উজ্জামান নির্মম হত্যকান্ডকে প্রধান্য দিয়ে এবং গুরুত্বের সাথে আমলে নিয়ে লাশের পরিচয় দ্রুত সনাক্ত এবং খুনিকে অল্প সময়ের মধ্যে গ্রেফতার করতে ফুলবাড়িয়া থানা ও জেলা গোয়েন্দা পুলিশকে নির্দেশ দেন।
এ ঘটনায় মামলা হলে পুলিশ সুপার তাৎক্ষনিক ডিবি পুলিশকে মামলা তদন্তসহ লাশের পরিচয় নিশ্চিত করে খুনিকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। পুলিশ সুপারের কঠোর নির্দেশনায় জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ওসি শাহ কামাল আকন্দের তত্বাবধানে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে ডিবির টিম সেখানে অবস্থান নেয়।
এদিকে সিআইডি পুলিশ, র্যাব, পিবিআই পুলিশও ছায়া তদন্তে নামে। ডিবি পুলিশ টানা ৪৮ ঘন্টা খোজ খবর নিয়ে ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে হত্যাকান্ডের একমাত্র ঘাতক রাজাবালিকে শুক্রবার রাতে তার নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে।
ডিবির ওসি শাহ কামাল আকন্দ জানান, লাশের পাশে পড়ে থাকা একটি বেনেডি ব্যাগে একটি মোবাইল নম্বর পাওয়া পাওয়া যায়। ঐ মোবাইল নাম্বারের সুত্র ধরে নিহতের আত্মীয় আল আমীনকে পাওয়া যায়। পরে ডিবি পুলিশ আল আমীনের কাছে নিহতের ছবি পাঠায়। ছবি দেখে আল আমিন লাশ সনাক্ত করেন এবং নিহতের বাবাকে খবর দেন। নিহতের বাবা মজিবর রহমান। তার বাড়ি টাঙ্গাইলের কালিহাতি থানার ছিন্নাই পাড়া গ্রামে। পরে মজিবর রহমান ফুলবাড়িয়া থানায় এসে তার মেয়ে পারভীন আক্তারের লাশ সনাক্ত এবং অজ্ঞাত আসামীদের নামে ফুলবাড়িয়া থানায় মামলা করেন। মামলা নং-১১(৬)২০২০। ধারা- ৩০২/২০১/৩৪ পেনাল কোড-১৮৬০।
ডিবির ওসি আরো জানান, অজ্ঞাত হত্যাকান্ডের খবর পেয়ে তাৎক্ষনিক ঘটনাস্থলে ডিবি টিম নিয়ে যাই। তথ্য সংগ্রহের চেষ্ঠা করি। বেনেডি ব্যাগে ছোট একটি কাগজে লেখা মোবাইল নম্বরের মাধ্যমে লাশের পরিচয় সনাক্ত হয়। প্রযুক্তির মাধ্যমে জানা যায় তার বাড়ি কালিহাতি এবং চাকুরী করতেন গাজীপুরের কোনাবাড়িতে। তবে আমি সহ ডিবি টিমকে ভাবিয়ে তুলে ঐ নারীর কোন আত্বীয় স্বজন ফুলবাড়িয়ায় নেই, তাহলে লাশ কিভাবে ফুলবাড়িয়ায়। এছাড়া হত্যাকান্ডও ফুলবাড়িয়ায় ঘটেছে এটা নিশ্চিত হই। তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে পর্যালোচনা শুরু করি। নিহত ভিকটিম লাভলী আক্তারের মোবাইল ফোনের সুত্র ধরে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিবি পুলিশ তদন্ত শুরু করে।
ডিবি পুলিশ টানা ৪৮ ঘন্টা মাঠে থেকে তথ্যানুসন্ধান ও তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিশ্চিত হয়, ফুলবাড়িয়ার বাক্তার শ্রীপুর গ্রামের রাজাবালি নামক এক ব্যক্তির সাথে নিহত লাভলী আক্তারের সাথে গত ৯ জুন রাতে কথা হয়েছে। এরই সুত্র ধরে ডিবির ওসি শাহ কামাল আকন্দের তত্বাবধানে এসআই আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে ডিবি পুলিশ শুক্রবার রাতে তার নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে।
গ্রেফতারকৃত রাজাবালির বরাত দিয়ে ওসি শাহ কামাল আকন্দ বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রাজাবালি পুলিশের কাছে হত্যাকান্ডের দায় স্বীকার করেছে। সে পুলিশকে জানায়, প্রায় ৬ মাস আগে মোবাইল ফোনে মিস কলের মাধ্যমে লাভলী আক্তারের সাথে তার পরিচয় হয়। এরপর ফোনে ফোনে তাদের গভীর সম্পর্ক। রাজাবালির কথিত প্রেমের ফাঁদে পা দিয়ে এবং প্রলোভনে পড়ে বিশ্বাস করে গামেন্টকর্মী লাভলী আক্তার। এক পর্যায়ে রাজাবালির ডাকে কিছু দিন আগে ফুলবাড়িয়ার শ্রীপুর গ্রামে চলে আসেন লাভলী আক্তার। উভয়ের মাঝে দৈহিক সম্পর্কও হয়। এর আগে লাভলী তার কাছে এলেও ভালো ভাবেই ফেরত পাঠিয়েছে রাজাবালি। একইভাবে ৯ জুন বিয়ের আশ্বাসে রাজাবালি গামেন্টকর্মী লাভলী আক্তারকে তার নিজ এলাকায় নিয়ে আসে। প্রেমের ছলনায় আবারো লাভলী আক্তারের সর্বস্ব কেড়ে নেয় রাজাবালি। সর্বস্ব হারিয়ে লাভলী তাকে বিয়ের জন্য চাপ দেয় রাজাবালিকে। রাজাবালি বিয়ে করতে অস্বিকার করে। কারণ রাজিয়া নামে তার স্ত্রী রয়েছে। প্রায় ২০ বছর আগে সে বিয়ে করেছে। বাকির হাসান, আবু রায়হান ও সাবিয়া আক্তার নামে তার তিন সন্তান রয়েছে। রাজাবালি পুলিশকে আরো জানায়, লাভলীকে বিয়ে করতে অস্বিকৃতি জানালে সে ওড়না দিয়ে ফাঁস দিয়ে আত্বহত্যার চেষ্টা করে। উপায়ান্তর না দেখে রাজাবালি পিছন দিক থেকে গামছা দিয়ে লাভলীকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। পরে তার লাশ কচুক্ষেতে ফেলে পালিয়ে যায়।
এর আগে লাভলীর বিয়ে হয়েছিল। সংসারে ৭ বছরের এক পুত্র সন্তান রয়েছে। স্বামীর সাথে বনিবনা না হওয়ায় ২ বছর ধরে গাজীপুরের কোনাবাড়িতে বাসা ভাড়ায় থেকে গার্মেন্টে কাজ করছিল।
এ ব্যাপারে পুলিশ সুপার আহমার উজ্জামান বলেন, যেহেতু লাশ ও খুনি অজ্ঞাত। তাই এই মর্মান্তিক ঘটনাকে প্রাধান্য দিয়ে দ্রুত লাশের পরিচয় সনাক্ত ও খুনিকে গ্রেফতারে ডিবিকে নির্দেশ দেই। এসআই আনোয়ার হোসেন বলেন, মামলার তদন্তভার পেয়ে ডিবির ওসি শাহ কামাল আকন্দের পরিকল্পনা ও তত্বাবধানে ঘটনা তদন্তসহ তথ্য প্রযুক্তি পর্যালোচনা শুরু করি। নাওয়া, খাওয়া, ঘুম বিহিন টানা ৪৮ ঘন্টার শ্বাসরুদ্ধ অভিযান চলে। নিহত লাভলী আক্তারের মোবাইলের সুত্র ধরে নিশ্চিত হই ফুলবাড়িয়ার রাজাবাজির সাথে তার শেষ কথা হয়েছে। ঐ সুত্র ধরে রাজাবালিকে গ্রেফতারের চেষ্ঠা করি। হত্যাকান্ডের পর সে পালিয়ে থাকলেও শুক্রবার রাতে সে নিজবাড়িতে আসেন। পরে তাকে গ্রেফতার করা হয়। রাজাবালি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকান্ডের বর্ণনা দিয়ে হত্যার দায় স্বিকার করে। শুক্রবার তাকে আদালতে পাঠানো হলে রাজাবালি হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে।