কওমি মাদরাসার সনদের স্বীকৃতি, তাবলিগ জামাত, রাজনৈতিক দলীয় অবস্থানসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বিভক্ত কওমি অঙ্গনের ভোট নিয়ে নানা জল্পনা কল্পনা চলছে। কওমি আলেমদের এই বিভক্তি তাদের ভোট ব্যাংকেও বিভক্ত করবে কি না এ নিয়েই কানাঘুষা হচ্ছে।
বিশেষ করে মহাজোট সরকারের শেষ সময়ে ঠিক নির্বাচনের তফসিলে ঘোষণার আগেই কওমি মাদরাসার সনদের স্বীকৃতি প্রদান এবং এ জন্য সরকার প্রধানকে কওমি আলেমদের ঐক্যের প্রতীক কওমি মাদরাসা বোর্ডের আয়োজনে শুকরিয়া মাহফিলের মাধ্যমে সংবর্ধনা প্রদানের ঘটনার প্রভাব নিয়েই নানা হিসাব-নিকাশ করছেন। এ নিয়ে কওমি অঙ্গনের বিভিন্নপর্যায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে কিছুটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে।
কওমি আলেমদের বেশির ভাগ শীর্ষস্থানীয় আলেমের মতে, কওমি আলেমদের দৃশ্যমান বিভক্তি প্রকৃত বিভক্তি নয়, এগুলো ইস্যুভিত্তিক ছোটখাটো বিভক্তি। কওমি সনদের স্বীকৃতি কওমি আলেমদের একটি ন্যায্য পাওনার বিষয়। এই ঘটনা ভোটের রাজনীতিতে কোনো প্রভাব ফেলবে না।
তবে অপর একটি ছোট অংশ মনে করছেন, কওমি সনদের স্বীকৃতি প্রদানসহ কিছু রাজনৈতিক বিভক্তির কারণে কওমি অঙ্গনের ভোট ব্যাংকে এবার কিছুটা হলেও ব্যত্যয় ঘটবে।
জানতে চাইলে কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড-বেফাকের মহাপরিচালক মাওলানা যোবায়ের আহমদ চৌধুরী বলেন, আপনি যেটাকে কওমি আলেমদের বিভক্তি বলছেন তার প্রভাব ভোটে পড়বে কি না আমি বলতে পারছি না। তবে এটা বলতে পারি, কওমি সনদ পাওয়া নিয়ে আলেমদের মধ্যে কোনো বিভক্তি ছিল না। তবে প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা দেয়া নিয়ে যে বিভক্তি দেখা দিয়েছিল সেটা ছিল চিন্তাগত। কারো কারো মতো ছিল এই সংবর্ধনা দেয়াটা কওমি চিন্তা-চেতনার পরিপন্থী। সেই সংবর্ধনার পর এখন আবার আমরা সবাই এক হয়ে গেছি। ফলে এক চিন্তার মধ্যেই আছি। ভোটের ক্ষেত্রেও আগের মতোই কওমি আলেমদের অবস্থান অভিন্ন থাকবে বলে মনে করি।
তবে বেফাকের মজলিসে আমেলার সদস্য ও গাজীপুর জেলা বেফাকের সেক্রেটারি মাওলানা ফজলুর রহমান কিছুটা ভিন্ন মত প্রকাশ করে বলেন, কওমি ভোট ব্যাংকের হিসাব-নিকাশে এবার কিছুটা ব্যত্যয় ঘটতে পারে। কারণ কওমি সনদ প্রদানের কারণে মহাজোট সরকারের ব্যাপারে কওমি আলেমদের মনোভাবের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও পরিবর্তন এসেছে। এর প্রভাব ভোটের ক্ষেত্রেও পড়তে পারে।
অতীতে স্থানীয় সরকার ও জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে কওমি আলেম উলামা, ছাত্রশিক্ষক কওমি শুভাকাক্সক্ষীদের ভোট ব্যাংক বড় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে বলে মনে করা হয়।
বিশেষ করে ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরের ঘটনার পর অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কওমি ভোট ব্যাংক বড় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছিল বলে তখন ব্যাপক আলোচনা ছিল। তখন বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের প্রার্থী বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছিলেন। শাপলা চত্বরের ঘটনার পর থেকে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবির বিষয়টি আর জোরালোভাবে না আসা, এখন নির্বাচনের আগেই মহাজোট সরকার কর্তৃক কওমি মাদরাসার সনদের স্বীকৃতি প্রদানের ঘটনা, কওমি আলেমদের একটি অংশের রাজনৈতিক অবস্থানে পরিবর্তন, তাবলিগ জামাত ইস্যুতে রক্তক্ষয়ী সঙ্ঘাত ইত্যাদি ইস্যুর কারণে কওমি ভোট ব্যাংকের বিষয় নিয়ে ফের আলোচনা চলছে। নির্বাচনের মনোনয়নের ক্ষেত্রে দল নিরপেক্ষ কওমি আলেমদের দু’য়েকজনের মহাজোট থেকে মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টার গুঞ্জন, কওমি আলেমদের নেতৃত্বাধীন দু’য়েকটি রাজনৈতিক দল ও জোটের ২০ দলীয় জোট এবং মহাজোটের সাথে আসন ভাগাভাগি, আসন পাওয়া না পাওয়ার বিষয়গুলো সামনে আসায় ভোটে কওমি আলেমদের প্রভাবের বিষয়টি প্রাধান্য পাচ্ছে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে নরানী মাদরাসাসহ আনুমানিক ৪০ হাজার কওমি মাদরাসা রয়েছে। আনুমানিক ২০ লাখ কওমি ঘরানার আলেম ওলামা সারা দেশে রয়েছেন বলে মনে করা হয়।
মাওলানা যোবায়ের আহমেদ আরো বলেন, কওমি সনদের স্বীকৃতি ও শোকরানা মাহফিলের কারণে আমরা কওমি আলেমরা সব আওয়ামী লীগ হয়ে গেছি এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। আপনি দেখবেন তাবলিগ ইস্যুতে আমরা কিন্তু প্রায় সব কওমি আলেম একই চিন্তায় আছি। তিনি বলেন, কওমি সনদের স্বীকৃতি প্রদান সরকারের কোনো কাজ না, এটা ন্যায্য পাওনা দেয়া। এতটুকু বলতে পারি, অন্য সরকার সেটির যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারেননি, এই সরকার সেটির মূল্যায়ন করেছে। মূল্যায়নের অর্থ এই নয় যে, এজন্য তাকে ভোট দিতে হবে, ওলামায়ে কেরাম ধানের শীষে ভোট দেবে না।
মাওলানা ফজলুল রহমান আরো বলেন, কওমি সনদের স্বীকৃতি প্রদানের ঘটনার পর কওমি আলেমদের ভোট আর একচেটিয়া থাকবে না। কিছুটা বিভক্ত হওয়ার আশঙ্কা আছেই। এছাড়া বিএনপি জোটও কোনো কোনো ক্ষেত্রে কওমিদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করেনি। এজন্য কওমি আলেমদের কিছু ভোট যেমন কিছু কওমি নেতৃত্বাধীন দলের বাক্সে পড়বে তেমনি কিছু ভোট আওয়ামী লীগ শিবিরে পড়তে পারে।
জানতে চাইলে বেফাকের মজলিসে শূরা ও আমেলার সদস্য, বারিধারার যাকারিয়া রিসার্স ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক মুফতি মিজানু রহমান সাঈদ বলেন, কওমি সনদ ইস্যুটি রাজনৈতিক ইস্যু ছিল না। সাধারণ আলেমরাও এটিকে রাজনৈতিক বিষয় মনে করেনি। ফলে ভোটের ক্ষেত্রে এই ইস্যু মৌলিক কোনো প্রভাব ফেলবে বলে মনে করি না। এই স্বীকৃতি নিয়ে আলেমরা তাদের নীতি আদর্শ বিমুখ হয়ে গেছে এটা মনে করার কারণ নেই। অবশ্যই দু’য়েকজন বা ছোট একটি অংশ ব্যতিক্রম করতে পারে, না হয় ভোটের ক্ষেত্রে ধর্মীয় ইস্যুগুলোকে সামনে আসবে এবং সেগুলোকে সামনে রেখেই সব কওমি আলেম ভোট দেবে বলে আমি মনে করি।
হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ও ঢাকা মহানগরীর আহ্বায়ক আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমীর কাছে কওমি আলেমদের বিভক্তির বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, কওমি আলেমদের চিন্তাগত এসব বিভক্তি ভোটের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলবে না। মহাজোট সরকারের সাথে দু’চারজন আলেমের আঁতাত কিংবা সমঝোতার সাথে সাধারণ কওমি আলেম ওলামা ও শুকাকাক্সক্ষীদের কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, কওমি সনদের স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়টি আমাদের প্রতি সরকারের কোনো এহসান বা অনুকম্পা নয়, এটি আমাদের প্রাপ্য জিনিস। এজন্য ভোটে হেরফের হবে না। আগের মতোই কওমি আলেমরা ঈমান আকিদা রক্ষার স্বার্থেই তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে। কারণ সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা বিশ্বাস, আল্লাহর রাসূলের অবমাননাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান নিশ্চিত করার দাবিসহ হেফাজতের ১৩ দফা ঈমানি দাবির বিষয়টি তামাদি হয়ে যায়নি। ভোট প্রয়োগের ক্ষেত্রে অতীতের মতোই এই বিষয়গুলো অবশ্যই কওমি আলেম ওলামা, ছাত্র-শিক্ষক শুভাকাক্সক্ষীরা বিবেচনায় আনবে।