করোনা সংক্রমণের লাগাম টানতে ৪০ জনের অধিক আক্রান্ত এলাকাকে রেড জোন এলাকা ঘোষিত করে লকডাউন করার পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ কমিটি। সেই সাথে একই সঙ্গে বেশি পরীক্ষা, কন্ট্রাক্ট ট্রেসিংসহ ১২ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। ময়মনসিংহ বিভাগ সম্পর্কেও এমনসব প্রস্তাব স্বাস্থ্য অধিদফতরে দাখিল করেছেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেসের অধ্যাপক ডা. ফজলুর রহমান। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় গত ২৮ মার্চ সরকারের গৃহীত স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পর্যালোচনা ও সমন্বয়ের লক্ষ্যে ময়মনসিংহ বিভাগের দায়িত্ব দেয়া হয় অধ্যাপক ডা. ফজলুর রহমানকে।
ময়মনসিংহ বিভাগ ছাড়াও দেশের অন্য ৭ বিভাগ সম্পর্কেও ১২ দফা সুপারিশ দাখিল করেছে বিশেষজ্ঞ কমিটি।
সরকারের কাছে কমিটির সদস্যরা এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব জমা দিয়েছেন। যা বর্তমানে যাচাই-বাছাই চলছে। শিগগিরই এটা বাস্তবায়নে যাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। প্রস্তাবে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে দেশের বিভিন্ন এলাকাকে রেড, গ্রিন ও ইয়েলো জোনে ভাগের কথা বলা হয়েছে। গত মঙ্গলবার সকালে এ প্রস্তাব স্বাস্থ্য অধিদফতরে দাখিল করা হয়।
সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশে করোনা পরিস্থিতি আরও দেড় থেকে দু’বছর চলমান থাকতে পারে। ততদিন গোটা দেশ লকডাউন রাখা সম্ভব নয়। তাই সংক্রমণের ওপর ভিত্তি করে করোনা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রস্তাবনাটি বুধবার দুপুরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের কাছে উপস্থাপন করেছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী এ প্রস্তাবনার ওপর আরও কিছু অবজারভেশন দেন। এটি সংশোধন করে শিগগিরই মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হবে। স্বাস্থ্য অধিদফতর ও মন্ত্রণালয় থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
কমিটির এক সদস্য বলেন, আমরা আরবান এলাকাগুলোকে বিভিন্ন জোনে ভাগ করে কার্যক্রম পরিচালনার একটি প্রস্তাবনা দিয়েছি। প্রস্তাবে আছে- যে এলাকায় ৪০ জনের বেশি করোনা আক্রান্ত পাওয়া যাবে, সেটি হবে রেড জোন। এ ৪০ জন কি মহল্লা হিসেবে ধরা হবে, নাকি ক্যাচমেন্ট এরিয়া, নাকি ওয়ার্ডভিত্তিক- সে ইউনিট ঠিক করতে হবে।
আমরা যে প্রস্তাবনা দিয়েছি এটাই চূড়ান্ত নয়। এক্ষেত্রে সরকার হয়তো সংখ্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আমরা একটা স্ট্যাট্রেজি দিয়েছি। এ সংখ্যা একটি ওয়ার্ড বা মহল্লাভিত্তিক হবে কিনা তা ঠিক করবে স্বাস্থ্য অধিদফতর। আর সরকার এটা কীভাবে করবে সেটা সিদ্ধান্ত সরকারের।
তিনি আরও বলেন, প্রস্তাবনায় রেড জোনের জন্য কী কী কাজ করতে হবে তার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। একইভাবে ইয়েলো ও গ্রিন জোনের করণীয়ও বলা হয়েছে। আমরা প্রস্তাবে বলেছি, যেটিকে রেড জোন ঘোষণা করা হবে সেই এলাকায় রেসট্রিকশন মুভমেন্ট থাকতে হবে। যাদের পজিটিভ হবে তাদের হাসপাতাল নিতে হবে। যারা রোগীর সংস্পর্শে এসেছেন তাদের হোম কোয়ারেন্টিন কনফার্ম করতে হবে। রেড জোন থেকে কাউকে বের হতে না দেয়ার প্রস্তাব করেছি।
তারপরও যদি কারও সেখান থেকে বের হতে হয় বা ঢুকতে হয় তা হলে একটি আইনের মাধ্যমে তা করতে হবে। রেড জোনের বিষয়ে ১২টি পয়েন্ট বাস্তবায়নের প্রস্তাব দিয়েছি। এসব সঠিকভাবে মানা গেলে সংক্রমণ রোধ সম্ভব হবে। তবে এটি এখনও অফিসিয়ালি ডকুমেন্ট হয়নি, তাই বিস্তারিত বলা যাবে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, বিশেষজ্ঞ কমিটি বলেছে কোনো এলাকায় শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১০ জনের মতো হয় এবং গত ২ সপ্তাহে নতুন কোনো রোগী শনাক্ত না হয়ে থাকে তা হলে সে এলাকাকে গ্রিন জোন বলা যেতে পারে। কোথায় রোগীর সংখ্যা ৩০ জনের নিচে হলে ইয়েলো জোন বলা যেতে পারে।
উনারা বলেছেন, রেড জোনে রোগীদের চিহ্নিত করতে হবে। ফ্ল্যাগ দিয়ে ওই জায়গায় সিল করতে হবে। ওই এলাকার কোনো লোককে বাইরে যেতে দেয়া যাবে না। নজরদারি করতে হবে। কারও উগসর্গ পাওয়া গেলে টেস্ট করতে হবে। রোগীর সংস্পর্শে যারা এসেছে তাদের খুঁজে বের করতে হবে। যদি ইয়েলো জোন হয় তা হলে রেড জোনের মতো কড়াকড়ি থাকবে না। তবে নজরদারিসহ অন্য ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেছেন।
গ্রিন জোনে সেখানকার লোক স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারবেন। এ কাজগুলো সিভিল প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ এবং কমিউনিটি ভলান্টিয়ার দেখাশোনা করবে। এটি বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রাথমিক প্রস্তাব। এটি নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। মন্ত্রী আরও কিছু অবজারভেশন দিয়েছেন। এরপর উনারা এটি বিশ্লেষণ করে আমাদের প্রস্তাব দেবেন। তারপরই এটি স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে দেয়া হবে।
২৮ মার্চ সরকার করোনাভাইরাস মোকাবেলায় গৃহীত স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পর্যালোচনা ও সমন্বয়ের লক্ষ্যে দেশে আটজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ নিয়ে একটি কমিটি করে। কমিটির একেকজন সদস্যকে একটি করে বিভাগের দায়িত্ব দেয়া হয়।
এর মধ্যে ঢাকা বিভাগের দায়িত্ব দেয়া হয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেনকে। চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক ডিজি অধ্যাপক এমএ ফয়েজ, রাজশাহীর বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেসের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী, খুলনার আইসিডিসিআরবির সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার ডা. ইকবাল আনোয়ার, ময়মনসিংহের বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেসের অধ্যাপক ডা. ফজলুর রহমান, সিলেটের পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি ডা. এজেএম ফয়সাল, ইউনিসেফের সাবেক প্রধান কর্মসূচি সমন্বয়ক ডা. তারিখ হোসেন এবং রংপুরের দায়িত্ব পান রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ডা. মো. মওদুদ হোসেন।