রাজধানীর পুরান ঢাকার ইসলামপুরে ন্যাশনাল ব্যাংকের একটি গাড়ি থেকে ৮০ লাখ টাকা উধাও হয়ে যায়। গাড়িতে ছিলেন চারজন। ব্যাংকের এক কর্মকর্তা, দুইজন সিকিউরিটি গার্ড আর ড্রাইভার। দিনে দুপুরে চারজন মানুষের সামনে থেকে ৮০ লাখ টাকা ভর্তি বস্তা উধাও হয়ে যায়।
কিন্তু গাড়িতে থাকা কেউ কিছুই জানেন না। এ এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। সরল চোখে, এটাকে ওই চারজনের কারসাজি হিসেবে ধরে নেওয়া খুবই স্বাভাবিক। ন্যাশনাল ব্যাংক কর্তৃপক্ষ গাড়িতে থাকা ওই চারজনকে আসামি করে ডিএমপির কোতোয়ালী থানায় একটি মামলা করে। তদন্তে নামে থানা পুলিশ। আর ঘটনার পরপরই ছায়া তদন্তে নামে ডিএমপির ডিবি দক্ষিণের কোতোয়ালী জোনাল টিম।
গাড়িতে থাকা ওই চারজনের সাথে কথা বলে পুলিশ এটা বুঝতে পারে, টাকাটা গাড়ি থেকে অন্য কেউ সরিয়েছে। কিন্তু কে সে? কীভাবে করলো? কখন করলো? সাথে কারা ছিল? অন্য কারও ইন্ধন আছে কি-না, এসব প্রশ্নের উত্তর জানা যে খুবই দরকার।
বাংলাদেশ পুলিশের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক পোস্টে জানানো হয়, শুরুতেই ঘটনাস্থল ধরে এগুতে থাকে পুলিশ। টাকা ভর্তি গাড়িটি যেখানে রাখা ছিল তার আশপাশের ভবনে থাকা সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করে পুলিশ। শুরু হয় চুলচেরা বিশ্লেষণ। অনেক ফুটেজ বিশ্লেষণের পর একটিতে দেখা যায়, থামানো গাড়ি থেকে এক ব্যক্তি বস্তা নিয়ে রিকশাযোগে চলে যাচ্ছেন। কিন্তু ওই ব্যক্তির মুখটা অস্পষ্ট।
ওই রিকশাটিকে অনুসরণ করে সড়কের অন্যান্য ভবনের ফুটেজ সংগ্রহ করে পুলিশ। এভাবে প্রায় শতাধিক ফুটেজ বিশ্লেষণে ওই ব্যক্তির মুখের একটি স্পষ্ট ছবি পাওয়া যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কে এই ব্যক্তি? কী তার পরিচয়? পুলিশের কাছে থাকা অপরাধীদের ছবির সাথে ওই ব্যক্তির চেহারা মেলাতে শুরু করে পুলিশ। কয়েক হাজার ছবি মেলানোর পর দেখা যায়, টাকার ওই বস্তাটি নিয়ে যাওয়া ব্যক্তির নাম হান্নান।
এবার হান্নানের অবস্থান শনাক্তে পুলিশের তদন্তে যুক্ত করা হয় প্রযুক্তির মিশেল। প্রায় ২০ হাজার মোবাইল নম্বর বিশ্লেষণ করার পর হান্নানের একটি মোবাইল নম্বর পায় পুলিশ। তবে নম্বরটি বন্ধ।
পরিস্থিতি বিবেচনায় ভিন্ন কৌশল নেয় পুলিশ। সিদ্ধান্ত হয় এমন কাউকে টার্গেট করার যিনি হান্নানের অবস্থান জানাতে পারবেন। বিভিন্ন সূত্র থেকে পুলিশ জানতে পারে, হান্নানের চতুর্থ স্ত্রী পারভীনের আলমগীর নামে এক ভাই আছেন। আলমগীরকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সিদ্ধান্ত নেয় পুলিশ। কিন্তু মুশকিলটা হলো, আলমগীরকে জিজ্ঞাসাবাদের খবর হান্নান জেনে গেলে পুরো পরিশ্রম বৃথা হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এছাড়াও আলমগীর যদি হান্নানের বিষয়ে সত্যি কিছু না জানে, তাহলে পুলিশ তাকে হয়রানি করেছে -এমন অভিযোগও উঠতে পারে।
‘প্রতিটি তদন্তে পুলিশকে কিছু না কিছু ঝুঁকি নিতেই হয়। এবার তার ব্যতিক্রম হয়নি। সম্ভাব্য ঝুঁকি মাথায় নিয়েই হান্নানের শ্যালক আলমগীরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। সে পুলিশের কাছে জানায়, ওই ৮০ লাখ টাকার বিষয়ে তার বোন পারভীন জানেন। পারভীন বর্তমানে ঢাকাতে নেই। সে শরীয়তপুরে আছেন। এমন সংবাদ পেয়ে পুলিশের একটি দল ছুটে যায় শরীয়তপুর। কিন্তু বাবার বাড়িতে পারভীনকে পাওয়া গেল না। চাচার বাসায় অভিযান চালিয়েও তাকে পাওয়া গেল না। পরবর্তীতে মামার বাড়ি থেকে পারভীনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে পারভীন জানায়, ন্যাশনাল ব্যাংকের ২০ লাখ টাকা তারা ইতোমধ্যেই খরচ করে ফেলেছেন। বাকি টাকা তার ঢাকার বাসায় আছে। হান্নান বর্তমানে কিশোরগঞ্জের ভৈরবে আছেন। এদিকে, পারভীনকে নিয়ে পুলিশের দলটি টাকা উদ্ধারের জন্য ঢাকার উদ্দেশ্য রওয়ানা দেয়।
অন্যদিকে, হান্নানকে ধরতে ডিবির আরেকটি দল কিশোরগঞ্জে যায়। শরীয়তপুর থেকে আসা ডিবির দলটি পারভীনকে নিয়ে তার ধোলাইখালের বাসায় অভিযান চালায়। সেখানে তার বাসার খাটের নিচ থেকে ৬০ লাখ টাকা উদ্ধার করে পুলিশ।
এদিকে, কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে হান্নানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। হান্নান পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের ৮০ লাখ টাকার নিয়ে যাওয়া ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দেয়। হান্নানের ভাষ্যমতে, ব্যাংকের টাকার ওই গাড়িটিকে অনেক সময় ধরেই ফলো করতে থাকে তারা। গাড়িটি ইসলামপুরে ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্রাঞ্চের সামনে থামিয়ে ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা ও একজন সিকিউরিটি গার্ড ভেতরে চলে যান।
তখন গাড়িতে ড্রাইভার ও আরও একজন সিকিউরিটি গার্ড ছিলেন। টাকার বস্তাটি গাড়ির ভেতরে রাখা ছিল। তার সাথে থাকা মোস্তফা, বাবুল মিয়া ও আরও দুই-তিনজন মিলে ড্রাইভার ও সিকিউরিটি গার্ডের সাথে কথা বলে ভাব জমিয়ে ফেলেন। এরপর গাড়ির চালককে কৌশলে ব্যাংকের ভেতরে পাঠান। ড্রাইভার গাড়ি রেখে ভেতরে গেলে তার সহযোগিরা বিভিন্ন কথা বলে সিকিউরিটি গার্ডকে অন্যমনস্ক রাখেন। তখন সুযোগ বুঝে গাড়ির দরজা খুলে টাকার বস্তাটি নিয়ে রিকশাযোগে হান্নান তার বাসায় চলে যান। পরবর্তীতে সুযোগ বুঝে দলের অন্য সদস্যরাও সেখান থেকে সরে পড়েন।
হান্নানও পুলিশের কাছে দাবি করেন, ৮০ লাখ টাকার মধ্যে ২০ লাখ ইতোমধ্যেই খরচ হয়ে গেছে। তার কিছু টাকা দলের সদস্যদের মধ্যে টাকা ভাগবাটোয়ারা করেছেন। ঋণ শোধ করেছেন। তার নামে মামলাগুলো পরিচালনা করতে খরচ করেছেন এবং মাজারে মানত পূর্ণ করে টাকা দিয়েছেন। তবে, পুলিশ হান্নানের তথ্যগুলো খতিয়ে দেখছে।
জিজ্ঞাসাবাদে হান্নান আরও জানান, তার বাসায় অস্ত্র আছে। এই তথ্যের ভিত্তিতে হান্নানের বাসায় তাকে নিয়ে অভিযান চালিয়ে একটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এছাড়াও তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দলের সদস্য মোস্তফাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ সময় মোস্তফার বাসায় অভিযান চালিয়ে আরও একটি আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করে পুলিশ।
পরবর্তীতে তাদের দেওয়া তথ্যে দলের অপর এক সদস্য বাবুল মিয়াকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ ঘটনার সাথে যুক্ত বাকি আসামিদের গ্রেফতারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে এবং এই দলটির কাছে আরও অস্ত্র আছে কিনা, সেটিও খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
এভাবেই, টানা ২১ দিন অক্লান্ত পরিশ্রমে দিন-রাত উজাড় করে ঘটনার পেছনে লেগে থেকে ন্যাশনাল ব্যাংকের চুরি হওয়া টাকার রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ।
এর আগে, গত ১০ মে রাজধানীর পুরান ঢাকায় বিভিন্ন শাখা থেকে উত্তোলন করা ন্যাশনাল ব্যাংকের ৮০ লাখ টাকার একটি বস্তা গাড়ি থেকে খোয়া যায়। দিনে দুপুরে ঘটে যাওয়া ওই চাঞ্চল্যকর ঘটনায় কোতোয়ালী থানায় একটি মামলা করে ন্যাশনাল ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
সোমবার (১ জুন) দিবাগত রাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে অভিযুক্ত ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা হলেন- মো. হান্নান ওরফে ব্রিফকেস হান্নান ওরফে রবিন ওরফে রফিকুল ইসলাম, মো. মোস্তফা, মো. বাবুল মিয়া ও মোছা. পারভীন। তাদের হেফাজত থেকে উদ্ধার করা হয় ৬০ লাখ টাকা ও দুটি বিদেশি পিস্তল।
মঙ্গলবার (২ জুন ২০২০) সকালে ডিবি কার্যালয়ে গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম পুলিশ কমিশনার মো. মাহবুব আলম প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, গত ১০ মে রাজধানীর পুরান ঢাকায় বিভিন্ন শাখা থেকে উত্তোলন করা ন্যাশনাল ব্যাংকের ৮০ লাখ টাকার একটি বস্তা গাড়ি থেকে খোয়া যায়।
দায়ের করা ওই মামলাটি কোতয়ালী থানা পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশের কয়েকটি টিম ছায়া তদন্ত শুরু করে। তদন্তের এক পর্যায়ে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সোমবার দিবাগত রাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়।