তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগানের সাথে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের সাইড লাইনে তার চীনা প্রতিপক্ষ শি জিনপিংয়ের সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত সপ্তাহে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের পর এরদোগান বলেন, তুরস্ক বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ইস্যুতে চীনের সাথে সহযোগিতা জোরদার করতে প্রস্তুত রয়েছে। অপর দিকে চীনা প্রেসিডেন্ট বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এরদোগানের সাথে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে।
জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে নেতাদের মধ্যে বৈঠকের মাত্র দুই দিন পরই তুরস্কের পার্লামেন্টের স্পিকার বিনালি ইলদিরিম সরকারি সফরে চীনে যান। সেখানে তিনি তার প্রতিপক্ষ ও চীনা প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াংয়ের সাথে সাক্ষাৎ করেন। ইলদিরিম ঐতিহাসিক সিল্ক রোডের প্রেক্ষাপটে তুরস্ক ও চীনের ভৌগোলিক অবস্থার গুরুত্ব তুলে ধরেন।
চীনা কর্মকর্তারা পারস্পরিক স্বার্থে প্রত্যেক ক্ষেত্রে তুরস্কের সাথে কাজ করতে প্রস্তুত আছেন বলে জানান। গত অক্টোবর মাসে তুরস্কে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেন, এরদোগানের সহযোগিতায় আঙ্কারা ও বেইজিং কৌশলগত অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। গত মাসে তুরস্কের বিচারমন্ত্রী আবদুল হামিদ গুলও চীনে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বিচারিক ইস্যুতে তার চীনা প্রতিপক্ষের সাথে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেন। স্বাগতিক দেশের বিচারিক ইস্যুতে আরো ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যেই এ সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। তুরস্ক ও চীনের মধ্যকার সম্পর্ক যে উষ্ণ পর্যায়ে পৌঁছেছে, তার অপর একটি চিহ্ন হলো গত তিন বছরে উভয় দেশের নেতারা ছয়বার বৈঠকে মিলিত হয়েছেন। এসব বৈঠকের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরের ইঙ্গিত এবং সহযোগিতার নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়।
১৯৭১ সালে দুই দেশের মধ্যকার আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত তুর্কি-চীন সম্পর্ক সঙ্গতিহীন রয়েছে। তবে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ও সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর আঙ্কারা ও বেইজিংয়ের মধ্যকার সম্পর্কে গতিসঞ্চারিত হয়েছে। বিশেষভাবে গত দশকে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৬ সালে জার্মানিকে ত্যাগ করে চীন তুরস্কের প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার হয়ে ওঠে। গত জুলাই মাসে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনের সাইড লাইনে এরদোগান-শি বৈঠকে বসেন এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরো জোরদার করতে সম্মত হন।
দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সিরিয়া থেকে আফ্রিকা পর্যন্ত বিভিন্ন ইস্যুতে কিছু রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেও সার্বিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অর্থনীতিই অধিকতর প্রাধান্য পেয়েছে। আর চীনের সাথে সম্পর্ক জোরদার করার ক্ষেত্রে তুরস্কের প্রধান আগ্রহ ও স্বার্থ হচ্ছে- বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েবের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক সহযোগিতা গড়ে তোলার জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি ভিশন। তুর্কি কর্মকর্তারা চীনের বড় বড় প্রকল্পে আঙ্কারার প্রবল উৎসাহের কথা বারবার জানিয়েছেন।
যা হোক, রাশিয়ার সাথে তুরস্কের ঘনিষ্ঠতাকে পশ্চিমা জোট থেকে তুরস্কের বেরিয়ে আসার প্রয়াস হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। তুর্কি-চীন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককেও একই দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে। তিনটি কারণে এ মূল্যায়নটি সঠিক নয়।
প্রথমত, চীনের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক তাৎপর্যপূর্ণভাবে তুরস্ক-রাশিয়া সম্পর্কের চেয়ে ভিন্নধর্মী। সিরিয়ার ব্যাপারে আস্তানা চুক্তির মধ্য দিয়ে আঙ্কারা-মস্কো সম্পর্ক গড়ে ওঠার পর মিডিয়া সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতেই সেখানে সামরিক সহযোগতিার বিষয়টিও উঠে আসে।
দ্বিতীয়ত, পশ্চিমা বিশ্বের সাথে তুরস্কের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সঙ্কট সৃষ্টি হওয়ার কারণেই তুরস্ক চীনের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলছে- এ ধারণাটিও সঠিক নয়। পশ্চিমা শক্তি হিসেবে এখানে ইইউ, ন্যাটো ও আমেরিকার কথা বুঝানো হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান একটি মাঝারি শক্তি হিসেবে তুরস্ক তার দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহযোগিতার জন্য বৈশ্বিক অংশীদার খুঁজছে। আর এ ক্ষেত্রে চীন একটি প্রভাবশালী অংশীদার হিসেবে এগিয়ে এসেছে।
তৃতীয়ত, তুরস্ক চীনকে পশ্চিমাদের বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করে না। পশ্চিমাদের সাথে তুরস্কের সম্পর্কের ক্ষেত্রে টানাপড়েন থাকা সত্ত্বে¡ও তুরস্ক এ ধরনের কোনো কিছু ভাবছে না।
অপর দিকে বলা যায়, তুরস্ক-চীন সম্পর্ক বিকশিত হলেও তা ফুলশয্যা নয়। কারণ, চীনের উইঘুর ইস্যু রয়েছে। তুর্কি বংশোদ্ভূত এ সংখ্যালঘু মুসলিমরা ঝিনজিয়াংয়ে বসবাস করেন। এ ইস্যু এখন দুই দেশের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ নয়। কারণ, এ ইস্যু নিয়ে একটি সমঝোতা হয়েছে।
সিরিয়ার যুদ্ধে চীনও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। তুরস্ক-সিরিয়া প্রশ্নে রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের মুখোমুখি হলেও এখন পর্যন্ত চীনের সাথে কোনো বিরোধে জড়ায়নি। অতীতে দেখা গেছে, কয়েকটি জোটের জন্য সিরিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা ক্ষেত্র এবং তুরস্ক ও চীন এখানে একটি অভিন্ন ক্ষেত্র খুঁজে পাওয়ার প্রয়াস চালাতে পারে।
আফ্রিকা হচ্ছে অপর একটি ক্ষেত্র, যেখানে চীনের প্রভাব ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। কিন্তু চীন সেখানে নতুন খেলোয়াড় তথা তুরস্কের মুখোমুখি হচ্ছে। তুরস্কও বর্তমানে তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আফ্রিকার ব্যাপারে উদ্যোগের অংশ হিসেবে তুরস্ক ওই মহাদেশে কয়েকটি দূতাবাস খুলেছে এবং সম্প্রতি সেখানে বড় অবকাঠামো প্রকল্প খুলেছে। অবশ্য আফ্রিকা মহাদেশে তুরস্কের বার্ষিক বাণিজ্য চীনের তুলনায় অনেক কম। তুরস্ককে আফ্রিকার নতুন আগন্তুক হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। অথচ ২৬ বছর আগে তুর্কি পার্লামেন্টে জাতিসঙ্ঘ থেকে আমন্ত্রণের পরিপ্রেক্ষিতে সোমালিয়ায় মার্কিন নেতৃত্বাধীন শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণের প্রতি সমর্থন দিয়েছিল। তুরস্কের আফ্রিকা ইস্যুর প্রধান দেশ হলো সোমালিয়া।
আফ্রিকা প্রশ্নে তুর্কি নীতি অন্যান্য কুশীলব এবং চীন থেকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে ভিন্ন, যেটি প্রধানত অর্থনীতিভিত্তিক। মনে হচ্ছে, তুরস্ক আফ্রিকা প্রশ্নে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। এ মহাদেশটি আঙ্কারা ও বেইজিংয়ের জন্য সহযোগিতার, না প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র হয়ে উঠবে- তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে।