বৈশ্বিক এই মহামারির কারণে বিশ্ব সেখানে থমকে দাঁড়িয়েছে তার প্রভাব যে আমাদের উপর পড়বে এটাই স্বাভাবিক। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্ব শিক্ষাব্যবস্থার মতো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়ও নেমে এসেছে এক অনিশ্চয়তা। সতেরোই মার্চ থেকে বাংলাদেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। কবে আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারব সেকথা নিশ্চিত করে এখনো কেউই বলতে পারছে না। আর একটি স্বাভাবিক অবস্থায় না গিয়ে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে খুলবে সেটাও নিয়মিত চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের মাঝে দিন দিন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়েই চলেছে। কবে খুলবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান? কখন হবে পরীক্ষা? আর যদি পরীক্ষা নাইবা হয় তাহলে কীভাবে তাদের পরবর্তী ক্লাসে প্রমোশন দেয়া হবে?
সবই আসলে সময় ও পরিস্থিতির উপর নিরর্ভশীল। তবে আশা করি, শিগগিরই এ পরিস্থিতির উত্তোরণ হবে। আর আমরাও একটি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবো। তারপরও আমাদের একটি বিকল্প ভাবনা মাথায় রাখতে হবে। সেটা হয়তো পরিবর্তিত পরিবেশ-পরিস্থিতির সাথে সাথে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অবহিত হতে পারব। রাতের শেষে আলোর দেখা মেলে। এ আঁধারও কেটে যাবে। হয়তো কিছু সময়, অর্থ আর জীবনের বিনিময়ে এ খেসারত গুণতে হবে আমাদের। তবুও জীবন বহন। সামনের দিকে এগিয়ে চলতে হবে সবার। চলাচলে স্থবিরতা থাকলেও চিন্তার জড়ত্ব ঘুচিয়ে ফেলতে হবে। পরিবেশের সাথে খাপ খায়িয়ে নিজেদের কাজ চালিয়ে যেতে হবে। সুস্থও রাখতে হবে নিজেকে।
এই মুহূর্তে যেসব কোমলমতি শিক্ষার্থী বাসা-বাড়িতে অবস্থান করছে তাদের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। মানসিকভাবে তারা যেন কোনোভাবে ভেঙ্গে না-পড়ে। তাদের সাথে কোনো ধরণের রূঢ় আচরণ করা যাবে না। যাতে তাদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।
যেহেতু ইতোমধ্যে বছরের একটি বড় সময় অতিবাহিত হয়েছে গেছে। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা তাদের সিলেবাস শেষ করতে পারেনি। যদিও সংসদ টিভির মাধ্যমে সরকার নিয়মিত ক্লাস চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এই ক্ষতিকে পুষিয়ে নিতে। এছাড়াও বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক অনলাইনভিত্তিক ক্লাসও পরিচালিত হচ্ছে। তারপরেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের কিছু অভিযোগ থাকছেই। তারা ক্লাসগুলো ভালো করে বুঝতে না-পারলে প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ থাকছে না এসব মাধ্যমে। এ সমস্যা দূরীকরণে এ ক্লাসগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারের মধ্য দিয়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে সংযুক্ত করে প্রশ্নোত্তর পর্ব নিশ্চিত করা যেতে পারে। একজন শিক্ষার্থী ভিডিওটি দেখে তার সমস্যার জায়গায় ম্যাসেনজারে প্রশ্ন করতে পারেন। শিক্ষকও দিয়ে দিতে পারেন এর সঠিক জওয়ার। সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হচ্ছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লাখো শিক্ষার্থীর যারা অনলাইন সুবিধার বাইরে রয়েছে। আর কখন কোন সময় কীভাবে ক্লাস হচ্ছে এ বিষয়ে তাদের স্পষ্ট ধারণা নেই। অথবা থাকলেও পর্যাপ্ত ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের অভাবে এ সুবিধা তারা কাজে লাগাতে পারছে না। এমনই প্রেক্ষাপটে দেশের এই সুবিধা বঞ্চিত বিভিন্ন জেলা উপজেলা ও গ্রামাঞ্চলের লাখো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কথা নতুন করে ভাবতে হবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে। এই পরিস্থিতির যদি শিগগিরই উন্নতি না-ঘটে তাহলে হয়তো শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এ ব্যাপারে অবশ্যই কোনো সিদ্ধান্ত আসবে।
তবে এই সংঙ্কটাপন্ন সময়ে অভিভাকদের সবচে বেশি কৌশলী হয়ে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার বিষয়ে খুব বেশি যত্নবান হতে হবে। শিক্ষাবর্ষের বেশ কিছু সময় ইতোমধ্যে তারা পার করে ফেলেছে। তাই যাতে তারা শ্রেণিভিত্তিক একাডেমিক বিষয়ে দুর্বল না-থাকে সেদিকে অভিভাবকদের অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। এখন আর সিলেবাসের উপর নির্ভরশীল হয়ে বসে থাকার সময় নেই। কারণ পেছনের ক্ষতিকে তো কাটিয়ে উঠতে হবে। প্রথম সাময়িক পরীক্ষার সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা আদৌ হবে কি না সেকথা এখনো বলা যাচ্ছে না। তাই নিজ সন্তানকে শ্রেণি উপোযোগী বিষয়গুলো আয়ত্ব করাতে হলে পরীক্ষা কেন্দ্রিক পড়াশোনার বাইরে গিয়ে পাঠ্যপুস্তকের সামগ্রিক বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে। মনোযোগ দিতে হবে পুরো বইয়ের জ্ঞানে। এখন যে বড় সুবিধা অনেক পরিবারের সন্তানেরা পেয়ে যাচ্ছেন তা হলো প্রায় অধিকাংশ পরিবারে ছেলেমেয়েরা মা-বাবা ভাইবোন সহ অনেককেই কাছে পেয়ে পাচ্ছেন। তারা তাদের টেক কেয়ার করতে পারছেন। ফলে বড়দের সহায়তায় তাদের একাডেমিক পড়াশোনা অনেক সহজ হয়ে যাচ্ছে। কঠিন বিষয়টিগুলো তারা পরিবারের অন্য সদস্যদের থেকে বুঝে নিতে পারছেন।
কিন্তু এক শ্রেণির শিক্ষার্থী দারুণ বেকায়দায় পড়ে যাচ্ছে এই পরিস্থিতিতে। যারা শিক্ষিত বাবা-মা বা ভাইবোন কর্তৃক শিক্ষা সহায়ক এই পারিবারিক সাপোর্টটি পাচ্ছে না। তাদের নিজেদের একাডেমিক কার্যক্রম চালিয়ে নিতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। তাদেরও হতাশার কোনো কারণ নেই। এই সময়টার জন্য তারা কেবল ওই বিষয়গুলোকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে স্টাডি করবে যা তারা নিজে থেকেই পড়ে বুঝে নিতে পারে। তবে যে বিষয়গুলো তাদের কাছে দুর্বোধ্য মনে হবে, সেগুলোর জন্য তারা প্রয়োজনবোধে সংশ্লিষ্ট শিক্ষককের সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করে নিতে পারে। অথবা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই নিজ প্রচেষ্টায় পাশ^বর্তী বাসা-বাড়ির সহপাঠী বা বড়দের থেকেও তারা বুঝে নিতে পারে। যদি এই সময়ে এমনটি করা ঝুঁকিপূর্ণ যদি সঠিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি না-মানা হয়। অথবা অনেকে এগিয়ে আসতে চাইবে না।
এর বিকল্প হিসেবে যেগুলো তারা এখন পড়লে বুঝতে পারবে যেগুলো নিয়মিত অনুশীলন নিয়মিত চালিয়ে যাবে। আর যেগুলো এখন পারবে না পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গিয়ে তা শিখে নেবে। তাহলে শিক্ষার্থীদের উপর করোনা পরবর্তী সময়ে লেখাপড়ার বাড়তি চাপ আসবে না। আর বিষয়ভিত্তিক দুর্বলতাও থাকবে না। কেউ এখনো জানে না আসলে সামনের দিনগুলোতে কী হতে যাচ্ছে।
বাসায় বসে তাই এই অফুরন্ত সময়টাকে কোনোভাবেই নষ্ট না-করে নিয়মিত পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে। সময় ঠিকই অতিবাহিত হবে। সিদ্ধান্তও আসবে। হয়তো সমন্বয় করে সংক্ষিপ্ত আকারে সময়ের বিবেচনায় কিছু একটা করা হবে। কিন্তু নিজের মধ্যে দুর্বলতা থেকে গেলে তা তাকে অনেকদিন সাফার করতে হবে। সুতরাং বি কেয়ার ফুল।
লেখক : শিক্ষক ও গবেষক