করোনার এই দুঃসময়েও চালের উৎপাদন নিয়ে পাওয়া গেল সুসংবাদ। চাল উৎপাদনে কয়েক বছরের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় শীর্ষ তিনের মধ্যে উঠে আসছে দেশ। আমন, আউশ ও বোরো—তিন মৌসুমেই চালের উৎপাদন ভালো হওয়ায় চলতি বছর শেষে চার লাখ টনের বেশি উৎপাদন বাড়বে। এতে চলতি অর্থবছরে (২০১৯-২০) উৎপাদন তিন কোটি ৬০ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে। এতে ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ চাল উৎপাদনকারী দেশ হয়ে উঠবে বাংলাদেশ।
এ সুসংবাদ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএ। বৈশ্বিক কৃষি উৎপাদন পরিস্থিতির সব শেষ তথ্য নিয়ে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয় হওয়ার এ পূর্বাভাস দিয়েছে ইউএসডিএ।
ইউএসডিএ থেকে প্রকাশ করা বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও খাদ্য উৎপাদন কেমন হতে পারে, সে বিষয়ক আরো একটি প্রতিবেদন গত সপ্তাহে প্রকাশ করা হয়। ইউএসডিএ থেকে প্রকাশিত বৈশ্বিক খাদ্যশস্য প্রতিবেদন ২০২০, মে শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিবেদন অনুসারে বিশ্বজুড়ে বৈরী আবহাওয়া ও নানা সংকটের কারণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি শস্য চাল, গম ও ভুট্টার উৎপাদন কমছে। কিন্তু ঠিক তার উল্টো চিত্র বাংলাদেশে। অনুকূল আবহাওয়া ও উপকরণ সহজলভ্য থাকায় এবার বাংলাদেশে ওই তিন খাদ্যশস্যের উৎপাদন রেকর্ড পরিমাণ বাড়বে। শুধু এই তিন শস্যের মোট উৎপাদন বাড়তে পারে প্রায় ১০ লাখ টন।
ইউএসডিএর অন্য এক প্রতিবেদন অনুসারে বাংলাদেশে গত এক বছরে চালের উৎপাদন বেড়েছে ৩ শতাংশ। জানা যায়, দেশে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেড়েছে চালের উৎপাদন। দীর্ঘদিন ধরেই খাদ্যশস্যটি উৎপাদনে বাংলাদেশের বৈশ্বিক অবস্থান ছিল চতুর্থ। চীন ও ভারতের পরই তৃতীয় স্থানটি ছিল ইন্দোনেশিয়ার।
ইউএসডিএর প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে সারা বিশ্বে ৫০ কোটি ২০ লাখ টন ছাড়াতে পারে চালের উৎপাদন, যা গত অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ২ শতাংশ বেশি। বরাবরের মতো চীন সবচেয়ে বেশি চাল উৎপাদন করবে। দেশটি এ অর্থবছরে ১৪ কোটি ৯০ লাখ টন চাল উৎপাদনের মাধ্যমে শীর্ষে অবস্থান করবে। চীনের পরই আছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত। দেশটির চাল উৎপাদন দাঁড়াবে ১১ কোটি ৮০ লাখ টন। এর পরই তিন কোটি ৬০ লাখ টন উৎপাদন নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে উঠে আসবে বাংলাদেশ। আর দীর্ঘদিন ধরেই তিন নম্বর স্থানটি দখলে রাখা ইন্দোনেশিয়া এবার চতুর্থ অবস্থানে নেমে যাবে। দেশটিতে চালের উৎপাদন হবে তিন কোটি ৪৯ লাখ টন। ইউএসএডির তথ্য মতে, গত বছর দেশে চাল উৎপাদন হয়েছিল প্রায় তিন কোটি ৫৬ লাখ টন।
ইন্দোনেশিয়া চলতি বছর খারাপ পরিস্থিতির কারণে উৎপাদন ধরে রাখতে পারেনি। তবে সামনের বছর দেশটি ঘুরে দাঁড়াতে পারে। এতে অবশ্য বাংলাদেশের জন্য তৃতীয় স্থান ধরে রাখাটা চ্যালেঞ্জিং হবে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এ বিষয়ে একুশে পদক পাওয়া কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমাদের আউশ, আমন ও বোরো তিন জাতের ধানের উৎপাদনই খুব ভালো হয়েছে এ বছর। ফলে আমাদের সার্বিক চালের উৎপাদন বাড়বে এটি প্রত্যাশিতই ছিল এবং এই ধারা অব্যাহতই থাকবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘ইন্দোনেশিয়া যদি আগের মতো উৎপাদনে ফিরে তবুও আমরাই এগিয়ে থাকব। কারণ আমাদের কৃষি খাতে টেকনোলজির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। এ ছাড়া বিগত কয়েক বছর ধরে উচ্চফলনশীল ধানের উৎপাদনও বাড়ছে।’
কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘দেশের কৃষকরাই এ অর্জনের প্রধান দাবিদার। এর সঙ্গে এ খাতে নিয়োজিত সম্প্রসারণকর্মী, বিজ্ঞানী, গবেষক ও বেসরকারি খাতের অবদান রয়েছে। তাদের সহায়তা করার জন্য আমরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। আমরা শুধু প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে উপকরণ, আর্থিক ও নীতিসহায়তা দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের সরকারপ্রধান কৃষি ও কৃষকদের জন্য অন্তঃপ্রাণ। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে দেশের চাল উৎপাদনে বৈশ্বিক এ সফলতা এসেছে।
ইউএসডিএর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এবার চাল উৎপাদনের শীর্ষ ১২টি দেশের মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার পরই থাকছে ভিয়েতনাম। দেশটিতে এবার উৎপাদন দাঁড়াবে দুই কোটি ৭৫ লাখ টন। এ ছাড়া থাইল্যান্ডে দুই কোটি চার লাখ টন, মিয়ানমারে এক কোটি ৩১ লাখ টন, ফিলিপাইনে এক কোটি ১০ লাখ টন, জাপানে ৭৬ লাখ ৫০ হাজার টন, পাকিস্তানে ৭৫ লাখ টন, ব্রাজিলে ৬৯ লাখ ও কম্বোডিয়ার প্রায় ৫৮ লাখ টন চাল উৎপাদন হবে।
এতে আরো বলা হয়, গত এক বছরে বিশ্বজুড়ে চালের উৎপাদন দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ কমেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় চাল উৎপাদনকারী দেশ চীনের উৎপাদন ১ দশমিক ১৯ শতাংশ কমেছে। বিশ্বের অন্যতম চাল রপ্তানিকারক দেশ থাইল্যান্ডে ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ, মিয়ানমারে প্রায় ২ শতাংশ উৎপাদন কমেছে। ভারত ও ভিয়েতনামে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১ শতাংশ। আর সবচেয়ে বেশি চালের উৎপাদন বেড়েছে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে, প্রায় ৩ শতাংশ।