আপাতত নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে খেলায় ফিরতে চান সাকিব আল হাসান। তবে ভবিষ্যতে রাজনীতিতে নামার সুযোগ পেলে তা গ্রহণ করবেন বলে জানিয়েছেন।
হাসতে হাসতে বলেছেন, ‘‘সুযোগ না পেলে আফসোসও করবো না।’’
জার্মানভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলে বাংলার ইউটিউব চ্যানেল ‘খালেদ মুহিউদ্দীন জানতে চায়’ অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে নিজের বর্তমান অবস্থা, ভবিষ্যত পরিকল্পনা, দলের অবস্থা, রাজনীতি ও তাকে ঘিরে নানা সমালোচনা নিয়ে খোলাখুলি কথা বলেন সাকিব।
বর্তমানে পরিবার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যের মেডিসনে আছেন তিনি। সেখানে গত ২৪ এপ্রিল সাকিবের দ্বিতীয় কন্যার জন্ম হয়৷ সাকিব মেয়ের নাম রেখেছেন ‘ইররাম’। বলেন, ইররাম শব্দের অর্থ জান্নাত।
করোনা ভাইরাসের কারণে লকডাউনের এই সময়ে পরিবার ও দুই মেয়েকে সময় দিচ্ছেন জানিয়ে সাকিব বলেন, ‘‘প্রথম মেয়ে জন্মের সময় কাছে থাকতে পারিনি। তেমন সময়ও দিতে পারিনি। এবার সেটা সম্ভব হচ্ছে। অবশ্যই খুব কঠিন সময় পার করছি। তবে আমি সব সময় খারাপের মধ্যও ভালো কিছু খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করি। মেয়ের জন্মের সময় স্ত্রীর পাশে ছিলাম। বাচ্চাকে সময় দিচ্ছি তবে খেলতে পারছি না এটা নিয়ে মনের ভেতর তো অস্বস্তি আছেই। যদিও পরিস্থিতির কারণে এখন কোনো খেলাই হচ্ছে না। কবে খেলা শুরু হবে সেটাও অনিশ্চিত। আমার নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ আরো ৫-৬ মাস আছে। তার আগে খেলা শুরু হয়ে গেলে আমি তো খেলতে পারবো না।’’
নিষেধাজ্ঞায় পড়ার এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়েছেন জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘‘খেলতে পারছি না, বা আরো কয়েক মাস খেলতে পারবো না এটা মনে হলে খারাপ তো লাগেই। কিন্তু এ ঘটনা আমার জন্য একটা বড় শিক্ষাও। অনেক কিছু ঘটে যেটা আমরা গুরুত্ব দেই না বা অবহেলা করি। এটা আসলে ঠিক না। এখন এ শিক্ষা আমার হয়েছে।’’
মাঠের পারফমেন্সে ধারাবাহিকতা ধরে রাখার কারণে খেলা নিয়ে সাকিবকে সমালোচিত হতে হয়নি। বরং মাঠের বাইরের নানা ঘটনায় তিনি অনেক বেশি সমালোচিত হয়েছেন। সম্প্রতি তার একটি প্রতিষ্ঠানে বেতনের দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলনের পর এই ক্রিকেটার বেশ হন। সে ঘটনার দীর্ঘ জবাবও তিনি দিয়েছেন।
নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠার নিয়ে চাপে আছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে সাকিব বলেন, ‘‘এখনো আমি ব্যবসায় পুরোপুরি জড়াইনি। তবে যেসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমার নাম আছে সেগুলোর দায়িত্ব তো আমাকে নিতেই হবে। আস্তে আস্তে এ বিষয়ে শিখছি। যেসব ঘাটতি আছে সেগুলো কিভাবে কাটিয়ে উঠা যায় সেগুলো নিয়েও ভাবছি।
‘‘আমি নিজের সমালোচনা স্বাভাবিকভাবেই নেই, নেতিবাচক মনে করি না। বরং এ সমালোচনা আমাকে আরো ভালো মানুষ হতে সহায়তা করেছে।’’
করোনা সংকটকালে সাধারণ মানুষকে সাহায্য করতে ‘সাকিব আল হাসান ফাউন্ডেশন’ গঠন করেছেন। এই ফাউন্ডেশন মূলত খেলাধূলা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত নিয়ে কাজ করবে বলে জানান তিনি। নিজের সন্তুষ্টির জন্য তিনি এ ফাউন্ডেশন গঠন করেছেন।
খেলোয়াড়দের অধিকার নিয়ে সব সময় সচেতন সাকিব উল্টো স্রোতে হেঁটে ক্রিকেট বোর্ডের কাছে নিজেদের দাবি দাওয়া জানাতে রীতিমত সংবাদ সম্মেলন ডেকে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন।
বোর্ড সেই সব দাবি পূরণ করেছে কিনা প্রশ্নের জাবাবে তিনি বলেন, ‘‘বেসিক বেশিরভাগ দাবিই পূরণ করা হয়েছে। যেগুলো হয়নি সেগুলো পূরণে সময় লাগবে। ওটার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।’’
অনেকের ধারণা বোর্ডের সঙ্গে ওই ঝামেলার কারণে সাকিবকে নিষেধাজ্ঞায় পড়তে হয়েছে। বা বোর্ড তার বিষয়টি আরেকটু ভালোভাবে ট্যাকেল করতে পারতো কিনা এমন প্রশ্নে কিছুটা হেসে সাকিব বলেন, ‘‘অ্যান্টি-করাপশন ইউনিট স্বাধীন ভাবে কাজ করে। সংস্থাটি আইসিসির অধীনে হলেও স্বাধীন। তাই এরকম ধারণা যাদের আছে তাদের এ ধারণা না রাখাই ভালো।’’
খেলায় ফিরতে মুখিয়ে থাকা সাকিব কিভাবে ফিটনেস ধরে রাখছেন জানতে চাইলে বলেন, ‘‘ঘরবন্দি এ সময়ে সবাই মানসিক চাপে আছে। আমিও এখন মানসিকভাবে নিজেকে চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করছি।’’
খেলায় ফেরার পর সাকিবকে অধিনায়ক হিসেবে দেখতে চান কিনা? ডয়চে ভেলে বাংলার একটি জরিপে ৩৯ শতাংশ দর্শক ‘হ্যাঁ’ এবং ৬৯ শতাংশ দর্শক ‘না’ এর পক্ষে ভোট দিয়েছেন। ‘না’ তে ভোট দেওয়া দর্শকরা মনে করেন অধিনায়কত্বের চাপ না নিয়ে বরং সাকিবের উচিত মাঠে সেরা পারফরমেন্স দেওয়ার দিকে বেশি মনযোগ দেওয়া।
এ বিষয়ে সাকিব বলেন, ‘‘আগে খেলায় ফিরতে চাই। বাকিটা পরে। যেখান থেকে আমার খেলাটা বন্ধ হয়েছে আমি ঠিক সেখান থেকে আবার শুরু করতে চাই, আমার কাছে এটাই এখন একমাত্র চ্যালেঞ্জ। খেলায় ফেরাটা আমার কাছে সবচেয়ে জরুরি।’’
২০২৩ সালের বিশ্বকাপ পরিকল্পনা নিয়ে তিনি বলেন, ‘‘একটা পরিকল্পনা তো সবারই থাকে। যদি সুযোগ পাই, সুস্থ থাকি এবং খেলতে পারি তবে তো খুব ভালো। দলও ভালো করবে বলে আমি মনে করি। ২০১৯ সালেও আমাদের ভালো সুযোগ ছিল, ছোট ভুলে হয়তো সেটা সম্ভব হয়নি। কিন্তু পরের বিশ্বকাপ এই উপমহাদেশ। তাই আমাদেরকে অন্য দলের ভয় করা উচিত হবে বলেই আমি মনে করি।’’
নিজের সাফল্য সবসময় দারুণ উপভোগ করেন। নিজের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেন। এ প্রসঙ্গে ২০১৯ বিশ্বকাপে হঠাৎ করেই তিন নম্বরে ব্যাট করতে নামা নিয়ে বলেন, ‘‘দলের ভারসাম্য রাখতে চার বা পাঁচ নম্বরে ব্যাট করতাম। তবে মনে হত উপরে ব্যাট করলে আরো রান করতে পারবো। সেটা হলে তো নিচের দিকের ব্যাটসম্যানদের উপর চাপই পড়বে না।
‘‘তাই আমি চ্যালেঞ্জ নিয়েই তিন নম্বরে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিলাম। সিদ্ধান্ত ভালো বা খারাপ তা বলবো না। দুইটাই ভালো বা দুইটাই খারাপ। তবে কি কারণে সিন্ধান্ত নিচ্ছি সেটাই আসল। উদ্দেশ্য ভালো না খারাপ। যদি ভালোর জন্য নেন এবং সবাই যদি সেটা বিশ্বাস করে তবে খারাপ হলেও সেটা ভালো হয়ে যাবে। আর সবাই বিশ্বাস না করলে ঠিক সিদ্ধান্তও খারাপ হয়ে যায়।’’
ওয়ানডে দলের নতুন অধিনায়ক তামিম ইকবাল সম্পর্কে সাকিব বলেন, ‘‘তামিম এর আগে ক্যাপ্টেন বা ভাইস ক্যাপ্টেন ছিল। ও একজন ভালো কোচ পেয়েছে। এছাড়া এখন দল পুনর্গঠনের কাজ চলছে। ও নিজের মত দল গড়ে নিতে পারবে। তাই আমি মনে করি ও অনেক ভালো করবে।’’
বর্তমান দলের কী কী ঘাটতি আছে এবং কী কী করলে দল আরো উন্নতি করতে পারবে এমন প্রশ্নে সাকিব বলেন, ‘‘বিশ্বকাপের পর প্রতিটি দলই একটা ট্রানজেকশনের মধ্য দিয়ে যায়। সিনিয়র অনেকে বিদায় নেন, নতুন খেলোয়াড় আসেন। তাই স্বাভাবিক ভাবেই দল নতুন করে গড়ে তুলতে এক দেড় বছর সময় লেগে যায়। আমাদের দল ঠিক ট্রাকেই আছে। সময় দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’’
অনুর্ধ্ব ১৯ দলের বিশ্বকাপ জয় খুবই অসাধারণ ঘটনা এবং তারা জাতীয় দলের হয়েও দেশের জন্য বিশ্বকাপ নিয়ে আসতে সক্ষম হবে বলে মনে করেন সাকিব। বলেন, ‘‘ওরা জানে কিভাবে বিশ্বকাপ জিততে হয়। ওরা অনেক ভালো খেলবে।’’
ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ছেড়ে মার্কিন মুলুকে পাড়ি জমানোর ইচ্ছা নেই জানিয়ে সাকিব বলেন, সুযোগ পেলে তিনিও মাশরাফীর মত রাজনীতিতে যোগ দিতে চান। ‘‘সব আসলে সময়ের উপর ছেড়ে দিতে হবে। কাল কী হবে তা কেউ জানে না। তবে ভবিষ্যতে সুযোগ আসলে অবশ্যই ওয়েলকাম করবো। কিন্তু সুযোগ না আসলে কোনো আফসোস থাকবে না।’’
২০১৯ সালে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন কিনা তা নিয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি এ ক্রিকেটার। বলেন, ‘‘কিছু জিনিস গোপন থাকাই ভালো। তাহলে মানুষের আমাকে নিয়ে আগ্রহ থাকবে।’’
অবসরের পর নিজের ফাউন্ডেশন নিয়ে জোরেশোরে কাজ করতে চান। এছাড়া, কৃষিখাতে আগ্রহ থাকায় এটা নিয়ে কাজ করতে চান জানিয়ে বলেন, ছোট বেলায় ধান কাটতে গিয়ে হাত কেটে ফেলছিলেন।