ইসলামের দৃষ্টিতে গিবত বা পরনিন্দা একটি মারাত্মক পাপ। অথচ এই প্রবণতাটি আমাদের সবার মধ্যেই কম-বেশি আছে। পবিত্র রমজানেও পরনিন্দার কবিরা গুনাহ থেকে আমরা অনেকেই মুক্ত থাকতে পারছি না। অথচ কোরআনে আল্লাহ তাআলা পরনিন্দাকে মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণের সঙ্গে তুলনা দিয়ে এ পাপ থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।
ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের কেউ যেন কারো পশ্চাতে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি স্বীয় মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করতে পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরা তো একে ঘৃণাই করো’। (সুরা হুজুরাত, আয়াত : ১২)।
আরো ইরশাদ হয়েছে—‘প্রত্যেক পশ্চাতে ও সম্মুখে পরনিন্দাকারীর জন্য দুর্ভোগ’। (সুরা হুমাজাহ, আয়াত : ০১)
আমরা মনে করি, যে দোষ মানুষের মধ্যে সত্যিই আছে তা চর্চা করলে গিবত হয় না। অথচ হাদিসের ভাষায় এটিকেই গিবত বলা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, গিবত হলো কোনো ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার এমন দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করা, যা শুনলে সে অসন্তুষ্ট হয় এবং অন্তরে আঘাত পায়, তাকেই গিবত বলে। অর্থাৎ কারো অগোচরে তার এমন দোষ বলা, যা বাস্তবেই তার মধ্যে আছে, তা-ই গিবত বা পরনিন্দা। আর যদি তার মধ্যে সেই দোষ না থাকে, তবে তা হবে অপবাদ (তুহমত)। যা পরনিন্দা থেকেও মারাত্মক গুনাহ। (মুসলিম, হাদিস : ২৫৮৯)
রাসুল (সা.) গিবতকে ব্যভিচার থেকে জঘন্য কাজ আখ্যা দিয়েছেন। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘গিবত ব্যভিচারের চেয়েও জঘন্যতম গুনাহ। তিনি রাসুল (সা.)-এর কাছে জানতে চাইলেন, এটা কিরূপে? তিনি বললেন, এক ব্যক্তি ব্যভিচার করার পর তাওবাহ করলে তার গুনাহ মাফ হয়ে যায়। কিন্তু যে গিবত করে তার গুনাহ প্রতিপক্ষ মাফ না করা পর্যন্ত মাফ হয় না’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৪১২)।
অন্য হাদিসে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা গিবত করা থেকে বেঁচে থাকবে। কারণ এতে তিনটি ক্ষতি রয়েছে। প্রথমত, গিবতকারীর দোয়া কবুল হয় না; দ্বিতীয়ত, গিবতকারীর কোনো নেক আমল কবুল হয় না এবং তৃতীয়ত, আমলনামায় তার পাপ বৃদ্ধি হয়ে থাকে। (বুখারি, হাদিস : ২৮৩৭)
গিবতের ভয়াবহতা বর্ণনা করতে গিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মিরাজের রাতে আমি কিছু লোককে দেখলাম, তাদের তামার নখ রয়েছে এবং তা দিয়ে তারা নিজেদের মুখমণ্ডল ও বুক আঁচড়াচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিবরাইল, এরা কারা? তিনি বললেন, এরা সেসব লোক যারা মানুষের গিবত করতো এবং তাদের ইজ্জত-সম্ভ্রম নিয়ে ছিনিমিনি খেলত।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮৭৯)
আমাদের সবার উচিত, পবিত্র মাহে রমজানে এই অভ্যাসটি সারা জীবনের জন্য ছেড়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করা। কারো ব্যাপারে নিন্দা করে থাকলে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া। যদি সে জীবিত না থাকে, তাহলে তার মাগফিরাতের দোয়া করা।
যাদের নিন্দা বা দোষ বর্ণনা করা জায়েজ
গিবত করা সর্বসম্মতভাবে হারাম। তবে সুপ্রসিদ্ধ হাদিস বিশারদ ইমাম নববী (রহ.) বলেন, সৎ ও শরিয়তসম্মত কার্যসিদ্ধির জন্য গিবত ব্যতীত অন্য কোনোভাবে যদি বলা সম্ভব না হয়, তাহলে গিবত করা জায়েজ। তাঁর মতে, ছয় ক্ষেত্রে গিবত বৈধ।
১. মজলুম ব্যক্তি জালেমের দোষ শাসক, বিচারক অথবা এমন কোনো ব্যক্তির নিকট বলতে পারবে যে তাকে জালেমের জুলুম থেকে মুক্তি দিতে পারবে।
২. সংশোধন করার ক্ষমতা রাখে এমন ব্যক্তির কাছে মন্দ লোকের দোষ বর্ণনা করা যাবে।
৩. মুফতির নিকট মাসয়ালা জানার প্রয়োজনে কোনো ব্যক্তির (সম্ভব হলে নাম উল্লেখ না করে) ত্রুটি বলা যাবে।
৪. কারো সঙ্গে বিয়ে বা ব্যাবসায়িক সম্পর্ক করার আগে তার সম্পর্কে অন্য ব্যক্তির পরামর্শ চাইলে মনে হিংসা-বিদ্বেষ না রেখে দোষ-গুণ স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া যাবে।
৫. সমাজে প্রকাশ্যে পাপ কাজ, বিদয়াত বা গোমরাহীর প্রসার ঘটায় এমন ব্যক্তির দোষ-ত্রুটিরও সমালোচনা করা যাবে।
৬. হেয় করা ব্যতীত নির্দিষ্ট উপনামে অথবা ছদ্মনামে পরিচিত ব্যক্তিকে চেনার সুবিধার্থে ছদ্মনাম বা খারাপ উপনামে ডাকা জায়েজ। (হিফজুল লিসান, পৃষ্ঠা ১৯)
আল্লাহ আমাদের সব সময় গিবতের মারাত্মক পাপ থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি রমজানে পরনিন্দামুক্ত রোজা পালনের তাওফিক দান করুক।