কথায় আছে, প্রেম এক অলৌকিক সত্তা, এক অদৃশ্য টান। মানে না জাতি-ধর্ম, বর্ণ কিংবা বয়স। বয়স তেরো-চৌদ্দ বছরের বেশি হবে না তাদের। এই দূরন্ত আর অবুঝ কৈশোরে দুজনের মধ্যে মিষ্টি ভালোলাগার সম্পর্ক তৈরি হয়। হয়তো দুজনের মনে প্রেম জন্মেছিল। হয়তো তারা জানতও না এই সম্পর্কের পরিণতি কী হতে পারে! আত্মীয়তার বিচারে এ সম্পর্ক সমাজ কীভাবে নেবে তা বোঝার মতো পরিপক্ক হয়নি এখনো তাদের মস্তিষ্ক। তাদের এই লুকোচুরি মেলামেশা অসামাজিক ও আপত্তিকর ঠেকে বড়দের চোখে। তাই সালিশ বসিয়ে কিশোরকে বিচারের জন্যে ডাকা হয়। সেখানে রায় দেয়া হয়, এ দুজনের বিয়ে দিতে হবে। নয়তো কিশোরীর বাবাকে ২০ শতক ফসলি জমি লিখে দিতে হবে ওই ছেলের বাবাকে। এ সিদ্ধান্তে অসহায় বোধ করেন, চাপে পড়ে যান কিশোরের বাবা। সালিশের সিদ্ধান্ত ঘোষিত হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
এ ঘটনা ঘটেছে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার উচাখিলা এলাকায়। ওই কিশোরের বাবার নাম আব্দুল হাই (৬০)। স্থানীয়রা বলছেন, এমন উদ্ভট সিদ্ধান্ত এবং আব্দুল হাইয়ের মৃত্যুর কথা গ্রামে জানাজানি হওয়ার পর সালিশকারীরা চাপে পড়ে গেছেন। বিষয়টি এখন ধামাচাপা দেওয়া চেষ্টা চলছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে মারা যাওয়া ব্যক্তির লাশও বিভিন্ন ছুতোয় দাফন করে ফেলেন সালিশকারীরা।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ওই গ্রামের আব্দুল হাইয়ের ছেলে মো. কাউসারের (১৫) সাথে প্রেমের সর্ম্পক গড়ে ওঠে একই বাড়ির মো. আনোয়ার হোসেনের মেয়ের (১৪)। আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকায় বিষয়টি বড়দের কাছে আপত্তিকর হয়ে ওঠে। ছেলের পরিবারে লোকজন এই সর্ম্পক কোনভাবেই মানতে পারেননি।
মৃত আব্দুল হাইয়ের আরেক ছেলে এনামুল হক জানান, প্রায় পনের দিন আগে মেয়ের সাথে তার ছোট ভাইকে বাড়ির অদূরে একসাথে কথা বলতে দেখে মেয়ের বাবা ঘটনাটি নিয়ে গ্রামের কয়েকজনকে জানান। এর ফয়সালা দিতে একটা সালিশের তারিখ নির্ধারিত হয়। গত রবিবার ছেলের বাড়ির উঠানেই স্থানীয় মাতব্বর সালাম, দুলাল ও মান্নানসহ অনেকেই এই সালিশে উপস্থিত ছিলেন। সালিশে সিদ্ধান্ত হয় আগামী দু’দিনের মধ্যে ছেলের বাবাকে দুটো পথের একটি বেছে নিতে হবে- হয় দুজনের বিয়ে দেয়া অথবা ২ কাঠা জমি মেয়ের নামে লিখে দিতে হবে। এ পরিস্থিতিতে ভেঙে পড়েন কিশোরের বৃদ্ধ বাবা। নির্ধারিত সময় পেরুনোর পর ছেলের বাবার পক্ষ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত না আসায় ফের সালিশের আয়োজন করা হয়।
জানা যায়, এ সালিশের নেতৃত্ব দেন গনু সরকার ও আশ্রাব উদ্দিন ভিটার। তারা গত বুধবার রাত ১১টার দিকে ছেলের বাড়িতে হাজির হয়ে মেয়ে ও ছেলের জবানবন্দি নিয়ে সিদ্ধান্ত দেন- ছেলেকেই বিয়ে করতে হবে। কিন্তু এ সিদ্ধান্তকে কোনভাবেই মেনে নিতে পারেননি আব্দুল হাই। এ সময় সালিশকারীরা উচ্চস্বরে ধমক দিয়ে আব্দুল হাইকে সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার জন্য চাপ দিয়ে চলে যান। পরক্ষণেই অসুস্থবোধ করেন আব্দুল হাই এবং অচেতন হয়ে পড়েন। পরে দ্রুত তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায় পরিবারের লোকজন। এ অবস্থায় গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে তিনি মারা যান। পরিবারের লোকজন জানান, সালিশে ছেলে বিয়ে না করলে মামলার ভয় দেখানো হয়। এতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আব্দুল হাই মারা যান।
এ ঘটনায় প্রথম দিনের সালিশকারী আব্দুস সালাম সরকার সালিশের ঘটনা সত্যতা স্বীকার করে বলেন, আমরা তো ছেলে মেয়ের ভালোবাসার সর্ম্পকের কারণে বিয়ের সিদ্ধান্ত দিছিলাম। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত ছেলের বাবা মানেননি। তাই আর খবর নেইনি।
দ্বিতীয় সালিশের নেতৃত্বদানকারী গনু সরকার জানান, সালিশ নয়, ওই বাড়িতে গিয়েছিলেন ছেলে মেয়ের ঘটনাটি মীমাংসা করার জন্য। ওই সময় কোনো ধরনের চাপ প্রয়োগ করা হয়নি। হাইয়ের অসুস্থতা দেখেই চলে আসি।
অন্যদিকে মেয়ের বাবা মো. আনোয়ার হোসেন জানান, মেয়ে ছেলের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে একটা সর্ম্পক চলছিল। এ অবস্থায় কোনোভাবেই দুইজনকে আলাদা করা যায়নি। এর একটা ফয়সালা করে দেওয়ার জন্য তিনি প্রথমে সালিশকারী সালাম সরকার, মান্নান ও দুলাল মিয়াকে জানান। তারা ব্যর্থ হলে বাড়ির পাশে গনু সরকারকে জানানো হয়। তিনিই গত বুধবার তার বাড়িতে গিয়ে একটা সিদ্ধান্ত দিয়ে আসেন। এর মধ্যে আব্দুল হাই যে অসুস্থ হবেন তা তিনি ভাবতে পারেননি। এই জন্য তিনি খুবই মর্মাহত।