‘ইউরোপ সাম্রাজ্ঞী’র বিদায়

জার্মানির ক্ষমতাসীন দল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রাট দলের প্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন দেশটির চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মের্কেল।

শুক্রবার ৭ ডিসেম্বর এক আবেগময় বিদায়ী ভাষণে মের্কেল তার দেশের ভেতরে এবং বাইরে জার্মানির উদার মূল্যবোধকে বাঁচিয়ে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।

সুদীর্ঘকাল এঙ্গেলা মের্কেল জার্মানির ক্ষমতায় আসীন রয়েছেন। নিজেকে তিনি একজন বিচক্ষণ ও বাস্তববাদী নেতা হিসাবে প্রমাণ করেছেন। একসময় তাকে বর্ণনা করা হতো ”জার্মানির রানি” হিসাবে এমনকী কেউ কেউ তাকে ডাকতেন ”ইউরোপের সাম্রাজ্ঞী” বলে।

আঠারো বছর তিনি তার দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন । আর পরপর চার মেয়াদে দেশটির চ্যান্সেলারের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি দলের নেতৃত্ব এখন ছাড়লেও চ্যান্সেলার হিসাবে তার চতুর্থ মেয়াদ শেষ করবেন ২০২১ সালে। তখন দেশটির প্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন মিসেস মের্কেল।

কাজেই ইউরোপের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি জার্মানির নেতৃত্বে তিনি ২০১২ সাল পর্যন্ত থাকলেও এটা এক অর্থে হবে সাময়িক দায়িত্বপালন।

মের্কেলের ক্ষমতার শক্ত ভিত প্রথম নড়ে যায় যখন শরণার্থীদের জন্য জার্মানির উন্মুক্ত-দ্বার নীতির নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার মুখে তাকে পড়তে হয়। তার এই নীতির ফলশ্রুতিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে দেশটির চরম ডান-পন্থীরা এবং তার দল প্রায় ৭০ বছরের নির্বাচনী ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ ফল করে ২০১৭ সালে।

মিসেস মের্কেল বলেছেন কোন রাজনৈতিক পদ নিয়ে তার ভবিষ্যত কোন পরিকল্পনা নেই। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে দুই জার্মানি একত্রিত হবার পর থেকে তিনি কোনো না কোনো রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করেছেন এবং এখন পর্যন্ত একাটার পর একটা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছেন।

ধর্মযাজকের কন্যা থেকে রাজনীতির অঙ্গনে
১৯৫৪ সালের ১৭ই জুলাই জার্মানির হামবুর্গ শহরে এঙ্গেলা কাসনারের। যখন তার বয়স মাত্র দুমাস তখন তার বাবাকে পূর্ব জার্মানির এক ছোট্ট শহরের এক গির্জার ধর্মযাজকের দায়িত্ব দেয়া হয়।

কম্যুনিস্ট পূর্ব জার্মানিতে বার্লিনের উপকণ্ঠে এক গ্রাম এলাকায় বড় হয়েছেন এঙ্গেলা মের্কেল। পদার্থবিদ্যায় ডক্টরেট করে এঙ্গেলা কাজ নেন পূর্ব বার্লিনের একটি বিজ্ঞান অ্যাকাডেমিতে রসায়নবিদ হিসাবে। ১৯৭৭ সালে সহপাঠী ছাত্র উলরিখ মের্কেলের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। কিন্তু চারবছর পর তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়।

১৯৮৯ সালের মধ্যে তিনি পূর্ব জার্মানিতে যে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গতিশীল হয়ে ওঠে তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন এঙ্গেলা। এরপর বার্লিন প্রাচীর যখন ভেঙে ফেলা হয়, তখন পূর্ব জার্মানিতে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পর তিনি পূর্ব জার্মান সরকারের মুখপাত্র হিসাবে কাজ নেন।

১৯৯০ সালে জার্মানির একত্রীকরণের দুমাস পর তিনি মধ্য দক্ষিণপন্থী ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রাট পার্টিতে (সিপিইউ) যোগ দেন। পরের বছর চ্যান্সেলার হেলমুট কোলের সরকারে তিনি মহিলা ও তরুণ বিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব নেন।

কোল অবৈধ অর্থ লেনদেনের এক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়লে মিসেস মের্কেল ১৯৯৯ সালে তার পদত্যাগ দাবি করেন। ২০০০ সালে সিপিইউ দলের নেতা নির্বাচিত হন।

২০০৫ সালে তিনি জার্মানির প্রথম নারী চ্যান্সেলার হন।

জার্মানিকে অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে টেনে তোলা
তার রাজনৈতিক জীবনের গোড়াতে তাকে দেখা হতো অনাকর্ষণীয় প্রাদেশিক সাদামাটা একজন নেতা হিসাবে। কিন্তু প্রথম থেকেই সেই ভাবমূর্তি তিনি ঝেড়ে ফেলতে উদ্যোগী হন তার পোশাকআশাক ও চেহারার পরিবর্তন ঘটিয়ে। তিনি চুলের স্টাইল বদলান, উজ্জ্বল রঙের পোশাক পরতে শুরু করেন।

তিনি ১৯৯৮ সালে ইয়োকিম সয়ারকে বিয়ে করেন।

তার প্রথম সরকার তিনি গঠন করেন মধ্য বামপন্থী সোসাল ডেমোক্রাটদের সঙ্গে একটা মহাজোট করে।

এরপর ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত তিনি ব্যবসা-বান্ধব ফ্রি ডেমোক্রাট দলের সঙ্গে জোট সরকার গঠন করেন।

ইউরোপ যখন অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তখন তিনি ব্যয়সঙ্কোচের প্রতীক হয়ে ওঠেন। দক্ষিণ ইউরোপের উপর্যুপরি ঋণ সমস্যার মোকাবেলায় তিনি ব্যাপক বাজেট হ্রাস এবং কড়া নজরদারির সুপারিশ করেন।

সমালোচকরা বলেন তিনি অর্থসঙ্কট সামাল দিতে বাড়তি অর্থসাহায্য দেবার ব্যাপারে প্রথমদিকে অনীহা প্রকাশ করেন। কিন্তু ইউরোজোনের আর্থিক সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে জার্মানিই পরে সবচেয়ে বড় ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এবং ইউরোর প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য ইইউর প্রয়াসের পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেন এঙ্গেলা মের্কেল।

গ্রিস ও স্পেনে বিক্ষোভকারীরা ব্যয়সঙ্কোচন নীতি বলবৎ করার জন্য জার্মানিকে দোষারোপ করে এবং মিসেস মের্কেলকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করে।

কিন্তু এই সঙ্কটের মধ্যে জার্মানির শক্ত অর্থনৈতিক অবস্থান, বেকারত্বের নিচু হার এবং বেশ ভাল মাত্রার রপ্তানি দেশের ভেতর তাকে জনপ্রিয় করে তোলে। জার্মানির মানুষ ব্যাপকভাবে মনে করে কঠিন সময়ে তিনি দেশের জন্য নিরাপদ একজন নেতা।

২০১৩ সাল নাগাদ ব্যয়সঙ্কোচ নীতি সম্পর্কে তিনি অপেক্ষাকৃত নমনীয় মনোভাব নেন। তিনি বলেন বেকারত্ব সমস্যা মোকাবেলার জন্য ইউরোপের শ্রমবাজার আরো উন্মুক্ত করা দরকার, যাতে তরুণরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কাজ খোঁজার সুযোগ পান।

উন্মুক্ত দ্বার নীতি
মিসেস মের্কেলের রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আসে যখন অভিবাসী ও শরণার্থীরা তাদের গন্তব্য হিসাবে বিপুল সংখ্যায় পাড়ি জমায় সফল অর্থনীতির দেশ জার্মানিতে।

২০১৫র জুলাই মাসে, দেখা যায় জার্মানিতে আশ্রয় পাবার জন্য কয়েকবছর ধরে অপেক্ষারত এক শরণার্থী নারীকে চ্যান্সেলার সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ এটাকে ভাল চোখে দেখেনি। তারা মনে করেছে তিনি সহমর্মিতা দেখান নি।

কিন্তু দলে দলে নতুন শরণার্থী আসার স্রোত যখন বাড়তে থাকে তিনি জার্মানির সীমান্ত খুলে দেন। শরণার্থীরা ইইউর যে দেশ দিয়ে ইউরোপে ঢুকছে সেখানে তাদের আশ্রয়াপ্রার্থী হিসাবে নাম নথিভুক্ত করার ইইউ নীতি তিনি সাময়িকভাবে স্থগিত করে দেন।

জাতিসংঘ তার এই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গীর ভূয়সী প্রশংসা করে। তিনি টাইম সাময়িকীতে সেবছরের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি নির্বাচিত হন এবং তাকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের “প্রকারান্তর নেতা” ঘোষণা করা হয়।

লক্ষ লক্ষ জার্মান নাগরিক তার এই বার্তায় কণ্ঠ মিলিয়ে বলে “আমরা মানিয়ে নেব”। কিন্তু এই উন্মুক্ত-দ্বার নীতিকে সবাই স্বাগত জানায় নি। চরম দক্ষিণপন্থীরা এই নীতির বিরোধিতা করে প্রচারণায় নামে।

দেশের পূর্বাঞ্চলে তারা ইসলাম-বিরোধী প্রচারণায় তৎপর হয়ে ওঠে। প্রচারণা পূর্বাঞ্চলের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে দেশের অন্যত্রও।

এরপর নববর্ষের এক অনুষ্ঠানে অভিবাসীদের দিক থেকে যৌন হয়রানির অভিযোগ এবং গ্রীষ্মকালে ইসলামী চরমপন্থী গোষ্ঠির হামলা এই প্রচারণাকে শক্ত ভিত্তি দেয়। ধাক্কা খায় মিসেস মের্কেলের জনপ্রিয়তা।

মিসেস মের্কেল স্পষ্ট করে না বললেও একরকম স্বীকার করতে বাধ্য হন তিনি ভুল করেছেন। তিনি বলেন, “যদি পারতাম ঘড়ির কাঁটা কয়েক বছর পেছনে নিয়ে যেতাম, শরণার্থীর ঢল সামাল দেবার জন্য দেশকে আগে

সেপ্টেম্বর ২০১৭র সাধারণ নির্বাচনে মিসেস মের্কেলের সিডিইউ দল খুবই খারাপ ফল করে। ১৯৪৯সালের পর এটাই ছিল দলের সবচেয়ে শোচনীয় ফল, যা ছিল মের্কেলের প্রতি জনসমর্থন তলানিতে যাওয়ার ইঙ্গিত।
এরপর থেকে জোট গঠন ও নির্ভরযোগ্য সরকার গঠন নিয়ে নানা জটিলতার মুখোমুখি হয়েছেন মের্কেল।

প্রাদেশিক নির্বাচনগুলোতে দেখা গেছে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রাট দলের প্রতি ও দলের নেতাদের প্রতি জনগণের আস্থা ও সমর্থনের অভাব।

বেশ কয়েকমাস আগেই মের্কেল ঘোষণা করেছিলেন দলের প্রধানের পদের জন্য তিনি আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। এবং বর্তমান মেয়াদের পর চ্যান্সেলার পদের জন্যও তিনি আর দাঁড়াবেন না। সমালোচকরা অনেকেই বলেছেন দলের খারাপ ফল থেকে এটা পরিষ্কার তার আগামীতে জেতার সম্ভাবনা সম্ভবত ক্ষীণ।

কিন্তু কারণ যাই হোক ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রাট দলের তিনিই সবচেয়ে বেশি মেয়াদে থাকা দলীয় প্রধান এবং আধুনিক জার্মানিতেও তিনিই সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতাসীন নেতা।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top