রমযান মাসের মর্যাদা অনেক। তাই এ মাসে আমলের গুরুত্ব ও ফজিলত অনেক বেশি। কুরআন মাজিদের বিভিন্ন আয়াতে এবং অনেক হাদীস শরীফে এ মাসের গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে। তার কিছু এখানে উল্লেখ করা হলো-
১. রমযান কুরআন নাযিলের মাস
– আল্লাহ তা’আলা এ মাসে পূর্ণ কুরআন মাজিদ একত্রে লওহে মাহফুয থেকে প্রথম আসমানে বাইতুল ইযযতে অবতীর্ণ করেন। অতপর রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট সর্বপ্রথম এ মাসেই ওহী অবতীর্ণ হয়। রমযান মাসের মর্যাদার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, এ মাসে কুরআন নাযিল হয়েছে।এ বৈশিষ্টের কথা কুরআন মাজিদেই উল্লেখ করা রয়েছে- “রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে।যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্য পথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশ।আর হক -বাতিলের মধ্য পার্থক্যকারী সুতরাং তোমাদের যে কেউ এ মাস পাবে সে যেন অবশ্যই এর রোজা রাখে। (সূরা বাকারা, আয়াত – ১৮৫)
২.মুমিনদের জন্য অধিকতর রহমত ও আমলের মাস
– হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন – “অথাৎ রমযান মাস শুরু হলেই রহমতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়।” ( সহীহ মুসলিম, হাদীস – ২৫৪৮)
৩. এ মাসে জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া হয়
মুমিন বান্দাগণ যাতে রমযানের সকল কল্যাণ লাভ করতে পারে এবং সকল নেককাজে পূর্ণ উৎসাহ -উদ্দীপনার সঙ্গে সহজেই অংশগ্রহন করতে পারে এজন্য পুরো রমযান শয়তানকে শৃঙ্খলাদ্ধ করে রাখা হয়। আর সুসংবাদ হিসাবে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন – “রমযান মাসের শুভাগমন উপলক্ষে জান্নাতের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। [সহীহ বুখারী, হাদীস -১৮৯৮ (১/২৫৫), সহীহ মুসলিম, হাদীস – ১০৭৯ (১/৩৪৬) ]
সুতরাং শয়তানের ফাঁদ থেকে মুক্ত থেকে বেশি বেশি ইবাদাতের মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলার রহমত পাওয়া ও জান্নাত লাভ করার এটিই সুবর্ণ সুযোগ।
৪. জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের মাস এবং দোয়া কবুলের মাস
– হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, আল্লাহ তা’আলা এ মাসের প্রতি রাতে অসংখ্য মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন সুতরাং আমাদের কর্তব্য, বেশি বেশি নেক আমল এবং তওবা – ইস্তেগফারের মাধ্যমে নিজেদেরকে এই শাহী ফরমানের অন্তর্ভূক্ত করা।
এ প্রসঙ্গে হযরত জাবির (রাঃ)থেকে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন – “অবশ্যই আল্লাহ তা’আলা (রমযান মাসে) প্রত্যেক ইফতারের সময় অসংখ্য ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন। আর তা প্রতি রাতেই হয়ে থাকে। [সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস- ১৬৪৩, মুসনাদে আহমদ, হাদীস – ২২২০২)
অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন- নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা রমযান মাসের প্রত্যেক দিবস ও রজনীতে অসংখ্য ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন।আর প্রত্যেক মুমিন বান্দার একটি করে দোয়া অবশ্যই কবুল করেন। [মুসনাদে আহমদ,হাদীস-৭৪৫০, মুসনাদে বাযযার, হাদীস ৯৬২]
৫. দান-খয়রাতের মাস
অনন্য আমলের মতো এ মাসে দান-সদকার ফযিলত ও গুরুত্ব অনেক বেশি। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন মানুষের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ দানশীল। তার দান (অন্য সময় হতে) অধিকতর বৃদ্ধি পেত রমযান মাসে, যখম জিবরাইল (আঃ) তার সঙ্গে সাক্ষাত করতেন। জিবরাইল (আঃ) রমযানের প্রতিরাতে আগমন করতেন এবং পরস্পরকে কুরআন শুনাতেন। তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর দানশীলতা কল্যাণবাহী বায়ুর চেয়েও অধিকতর হয়ে যেত।
৬. সওয়াব বৃদ্ধির মাস
-রমযান মাস মুমিনের নেক আমলের প্রতিদান বৃদ্ধির মাস এবং আখেরাতের সওদা করার শ্রেষ্ঠ সময়। দুনিয়ার ব্যবসায়ীদের যেমন বিশেষ বিশেষ মৌসুম থাকে, যখন খুব জমজমাট ব্যবসা হয় এবং বছরের অন্য সময়ের তুলনায় আয়-উপার্জন ও মুনাফা বেশি হয়,তেমনি আখেরাতের ব্যবসায়ীদের জন্য ব্যবসার শ্রেষ্ঠ মৌসুম হচ্ছে রমযান মাস।এ মাসে আমলের সওয়াব বহুগুন বৃদ্ধি করা হয়। যেমন এ মাসে উমরার সওয়াব অন্য মাসের তুলনায় অনেক বেশি।
হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে – হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক আনসারি মহিলাকে বললেন, “রমযান মাস এলে তুমি ওমরা করবে।কেননা এ মাসের উমরা একটি হজ্বের সমতূল্য।” (সহীহ বুখারী, হাদীস – ১৭৮২, মুসনাদে আহমেদ, হাদীস – ৩০৯৮)
৭.মাগফিরাতের মাস –
হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, “পাঁচ ওয়াক্ত নামায, এক জুম্মা থেকে জুম্মা এবং এক রমযান থেকে আরেক রমযান মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহসমূহকে মুছে দেয় যদি সে কবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে।” (সহীহ মুসলিম, হাদীস- ৮৯৬৬)
হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বলেন, রমযান মাস লাভকারী ব্যক্তি যদি উত্তমরূপে সিয়াম ও কিয়াম (রোজা,তারাবীহ ও অন্যন্য আমল)পালন করে তবে তার প্রথম পুরষ্কার এই যে,সে রমযান শেষে গুনাহ থেকে ঐ দিনের মতো পবিত্র হয়, যেদিন মায়ের গর্ভ ভূমিষ্ট হয়েছিল।(মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা, হাদীস- ৮৯৬৬)
ক্ষমা ও মাগফেরাতের এমন সুবর্ণ সুযোগ পেয়েও যে নিজের পাপসমূহ ক্ষমা করাতে পারেনা,সে সত্যিই ক্ষতিগ্রস্ত।হাদীস শরীফে তার উপর অভিশাপ করা হয়েছে।হযরত কাব ইবনে উজরা (রাঃ) বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের বললেন,
“তোমরা মিম্বরের কাছে এসো,আমরা এলাম।যখন তিনি মিম্বরের প্রথম ধাপে পা রাখলেন তখন বললেন আমীন।যখন দ্বিতীয় ধাপে পা রাখলেন বললেন আমীন।যখন তৃতীয় ধাপে পা রাখলেন তখন বললেন আমীন। হযরত কাব ইবনে উজরা (রাঃ) বলেন, যখন তিনি মিম্বর থেকে অবতারণ করলেন আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ, আজ আমরা আপনাকে এমন কিছু বলতে শুনেছি যা ইতিপূর্বে কখনো শুনিনি।উত্তরে তিনি বললেন, জিবরাইল (আঃ) আমার নিকট আগমন করেছিলেন যখম আমি প্রথম ধাপে পা রাখলাম,তখন তিনি বললেন, ধংস হোক ঐ ব্যক্তি যে রমজান মাস পেল তবুও তার গুনাহ মাফ হলো না, আমি বললাম আমীন।
যখন দ্বিতীয় ধাপে পা রাখলাম তখন বললেন, ধংস হোক ঐ ব্যক্তি যার কাছে আপনার নাম উচ্চারিত হলো অথচ সে আপনার উপর দুরুদ পড়লো না,আমি বললাম আমীন।যখন তৃতীয় ধাপে পা রাখলাম তখন বললেন, ধংস হোক ঐ ব্যক্তি যে বৃদ্ধ পিতামাতা উভয়কে অথবা একজনকে পেল অথচ তারা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারল না।( অর্থাৎ তাদের খেদমতের মাধ্যমে সে নিজেকে জান্নাতবাসী করতে পারল না) আমি বললাম আমীন। ( মুসতারাদে হাকীম, হাদীস-৭৩৩৮)
৮. লাইলাতুল কদরের মাস
– আল্লাহ রব্বুল আলামীনের পক্ষ হতে মুসলিম উম্মাহর জন্য এই মাসে আরেকটি বিশেষ দান হলো,এক হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম রজনী লাইলাতুল কদর। এই রজনী এত মর্যাদাপূর্ণ যে, এক হাজার মাস ইবাদাত করলেও যে সওয়াব হতে পারে,লাইলাতুল কদরের ইবাদাতে তার চেয়ে বেশি সওয়াব পাওয়া যায়।তাই এই রাতের কল্যাণ হতে বঞ্চিত হওয়া চরম দূর্ভাগ্যের বিষয়।আল্লাহ তা’আলা এ রাত সম্পর্কে এরশাদ করেছেন –
“লাইলাতুল কদর হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এ রাতে ফেরেশতাগণ ও রুহ জিবরাইল (আঃ) পৃথিবীতে অবতারণ করেন তাদের পালনকর্তার আদেশক্রমে সকল কল্যাণময় বস্তু নিয়ে। যে রাত পুরোটাই শান্তি, যা সুবহে সাদিক পর্যন্ত অব্যহত থাকে। (সূরা কদর, আয়াতঃ ৩-৫)
কিতাব- “হাদীস ও আছারের আলোকে মাহে রমযানের ফাযায়েল আমাল ও মাসায়েল” [ফাতওয়া বিভাগ দারুল কুরআন ওয়াল -উলুমিল ইসলামিয়া ঢাকা। (কুরআন শিক্ষা ও গবেষণামূলক উচ্চতর ইসলামী শিক্ষা এবং দাওয়াহ প্রতিষ্ঠান) ]