রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শেণীর ছাত্রী অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যার ঘটনায় দেশবাশী আতঙ্কিত। বিশেষ করে অভিবাক শ্রেণী। কেন কিশোর বয়সেই আত্মহত্যার পথ বেঁছে নিলো অরিত্রী। আসলে কী ঘটেছিলে সেদিন? দোষ কি আরিত্রীর, অভিভাবকের, নাকি শিক্ষকদের, এ নিয়ে চলছে নানা বিশ্নেষণ।
এরইমধ্যে আত্মহত্যার ঘটনায় প্ররোচনাকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, শাখা প্রধান এবং এক শ্রেণিশিক্ষককে চিহ্নিত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের করা তদন্ত কমিটি।
গত বুধবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জমা দেওয়া এই তদন্ত প্রতিবেদনে অরিত্রীর আত্মহত্যা আগে তার ও তার বাবা-মার সঙ্গে বিদ্যালয়ে যা করা হয়েছিল তার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
কমিটি বলছে, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস, শাখা প্রধান জিনাত আখতার এবং শ্রেণি শিক্ষিকা হাসনা হেনার অশোভন আচরণ, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং অরিত্রীর বাবা-মার সাথে অধ্যক্ষ ও শাখা প্রধানের নির্দয় আচরণ অরিত্রীকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে এবং তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে।
কমিটির প্রতিবেদনে ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে বলা হয়, ২ ডিসেম্বর দিবা শাখায় প্রতিষ্ঠানের ১২৮ নম্বর কক্ষে বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বিষয়ের বার্ষিক পরীক্ষা চলছিল। পরীক্ষা চলাকালে আনুমানিক ৩ টা ২০ মিনিট থেকে তিনটা ২৫ মিনিটের সময় দুই পরিদর্শক অরিত্রীর কাছ থেকে একটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করেন। অরিত্রীর কাছ থেকে উদ্ধার করা মোবাইলে ওই দিনের পরীক্ষার বিষয়ের পাঠ্যবইয়ের সিলেবাসের অংশটুকু ছবি তোলা ছিল। দুই পরিদর্শক মোবাইল পাওয়ার পর উত্তরপত্রের সাথে মোবাইলে ধারণ করা বিষয়ের কোনো মিল আছে কি না তা নিশ্চিত না হয়েই অরিত্রীকে পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে যেতে বলেন এবং পরের দিন ৩ ডিসেম্বর অভিভাবকসহ অধ্যক্ষ ও শাখা প্রধানের সাথে দেখা করতে বলেন। তবে কক্ষ পরিদর্শকেরা অরিত্রীকে কোনো তিরস্কারমূলক কথা বলেননি বলে ছাত্রীরা মত দেয়।
ঘটনার প্রেক্ষাপটে এবং বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ৩ ডিসেম্বর অরিত্রী অধিকারীর বাবা দিলীপ অধিকারী ও তার স্ত্রী আনুমানিক ১০টায় বিদ্যালয়ে যান এবং কিছু সময় অবস্থান করার পর অনুমতি সাপেক্ষে শাখা প্রধান জিনাত আখতারের সাথে সাক্ষাৎ করেন। জিনাত আখতার ইন্টারকমে অধ্যক্ষের সাথে আলোচনা করে প্রতিষ্ঠানের নিয়মানুযায়ী ‘নকলকারীকে’ আর পরীক্ষা দিতে দেওয়া হবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন এবং শিক্ষার্থীর বাবা-মার সাথে অশোভন আচরণ করেন।
শুধু তাই নয়, অরিত্রীকে টিসি দেওয়ার সিদ্ধান্ত মৌখিকভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়। শাখা প্রধানের সাথে অরিত্রীর বাবা-মা দেখার করার সময় বাবাকে একটি ময়লা চেয়ারে বসতে বলেন। কিন্তু অসুস্থ মাকে বসতে বলেননি। অরিত্রীর মা শাখা প্রধানের সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলেছেন। এ বিষয়ে সিসি ক্যামেরার ফুটেজও সংরক্ষিত আছে।
শাখা প্রধানের কাছ থেকে হতাশ হয়ে তারা শেষ সুযোগের আশায় অধ্যক্ষের সাথে সাক্ষাৎ করেন। অরিত্রীর ভুলকে স্বীকার করে তার বাবা অধ্যক্ষের কাছে হাতজোড় করে শেষবারের মতো তার মেয়েকে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু অধ্যক্ষ প্রতিষ্ঠানের চলমান নীতিমালা জানিয়ে বলেন, তার মেয়ের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করার কোনো সুযোগ নেই।
প্রয়োজনে আগামী দিনে এসে মোবাইলসহ টিসি নিয়ে যেতে বলেন। এই ঘটনার সময় অরিত্রী ও তার মা অধ্যক্ষের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেও কখনো অসুস্থ মাকে বসতে বলেননি। অরিত্রী দাঁড়িয়ে তার বাবা-মার অনুনয়-বিনয় ও আকুতি পর্যবেক্ষণ করার পর যখন দেখতে পায় তার বাবা মায়ের আবেদন রক্ষা করা তো দূরের কথা বরং তাদের অপমান করা হচ্ছে, তখন সে বাবা-মাকে কিছু না বলে অধ্যক্ষের কক্ষ থেকে বেরিয়ে বাসায় চলে যায়। কিন্তু তার বাবা-মা তখনো শেষবারের মতো সুযোগ দেওয়ার জন্য অধ্যক্ষকে অনুরোধ করে যাচ্ছিলেন। শেষ ভরসা হারিয়ে মা বাসায় চলে যান এবং বাবা পরিচালনা কমিটির সভাপতির শরণাপন্ন হয়ে বিষয়টি পুন: বিবেচনার জন্য পদক্ষেপ নিতে বলেন। কিন্তু কোনো সমাধান তিনি পাননি।
এ ছাড়া তিনি অন্য কোনো মাধ্যমে উপকার পেতে পারেন কি না সে চিন্তায় বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে দৌড়াদৌড়ি করতে থাকেন। আনুমানিক বেলা একটা থেকে দেড়টার মধ্যে বাসা থেকে ফোনে আসে। বলা হয়, অরিত্রী বাসার কক্ষে দরজা আটকে দিয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে অরিত্রীর বাবা বাসায় ফিরে যান এবং দরজা ভাঙতে না পেরে ভেন্টিলেটর ভেঙে দেখতে পান অরিত্রী ফ্যানের সাথে গলায় ফাঁস নিয়েছে। তাকে দ্রুত নামিয়ে কাছের হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত বলে জানিয়ে দেয়।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, শিক্ষার্থীর পরীক্ষায় খাতায় যে উত্তর লিখেছে তার সাথে জব্দ করা মোবাইলে ধারণ করা বিষয়ের সঙ্গে কোনো মিল আছে কি না তাও যাচাই করে দেখা হয়নি। তদন্তে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়েছে যে, উত্তরপত্রের সঙ্গে মোবাইলে ধারণ করা বিষয়ের কোনো মিল নেই।
শিক্ষার্থীকে টিসি দেওয়ার যে হুমকি দেওয়া হয়েছে তার আইনগত কোনো ভিত্তি ছিল না বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এ সংক্রান্ত ১৯৬১ সালের আইনের তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, আইনে তাৎক্ষণিক এ ধরনের কোনো শাস্তি দেওয়ার সুযোগ নেই। এই হুমকি ও শিক্ষার্থীর সামনে অপমান ও অপদস্থ করার বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় অরিত্রী আত্মহননের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
কমিটি বলছে এই অবস্থা এক দিনে তৈরি হয়নি। প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ও শাখা প্রধান (শিফট ইনচার্জ) অভিভাবকদের সাথে সাক্ষাৎ করতে চান না এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সদাচরণ করেন না। হঠাৎ সাক্ষাতের সুযোগ হলেও তারা অভিভাবকদের সাথে চরম অশোভন আচরণ করেন বলে তদন্তকালে অনেক অভিভাবক অভিযোগ করেন। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের সাথে কোনো বিষয়ে কাউন্সেলিং বা মতবিনিময় না করে কথা কথায় টিসি দেওয়ার ভয় দেখান।
তদন্ত কমিটি ওই তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধের আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে। এর ভিত্তিতে ইতিমধ্যে ওই শিক্ষককে বরখাস্ত এবং এমপিও (বেতন-ভাতার সরকারি অংশ) বন্ধ করা হয়েছে। শ্রেণি শিক্ষক হাসনা হেনাকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।
কমিটি মনে করে, প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি এই পরিস্থিতিকে যথাযথ গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেনি। কমিটির মনে হয়েছে, পরিচালনা কমিটি অভিযুক্তদের রক্ষার চেষ্টা করেছে। এমন পরিস্থিতিতে বর্তমান পরিচালনা কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন পরিচালনা কমিটি গঠন করা যেতে পারে বলে কমিটি মনে করে।