দার্শনিক রুশোর ভাষায় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও গৌরবান্বিত শিল্প হচ্ছে কৃষি। কৃষিকাজ শুরুর ইতিহাস প্রাচীন। মানব সভ্যতার বিকাশের সাথে কৃষি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রকৃতিকন্যাখ্যাত আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির অর্থনীতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে দীর্ঘ পরিক্রমায় কৃষি বর্তমান অবস্থায় পোঁছেছে। কৃষির আধুনিকায়ন ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে কৃষি আজ অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। অপরিকল্পিত শিল্পায়ন,নগরায়ন ও ক্রমুবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপে প্রতিনিয়ত আবহাওয়া পরিবর্তিত হচ্ছে। যার ফলে প্রতিনিয়ত দেখা দিচ্ছে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি সহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ। পরিবেশ দূষণের ফলে দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন মানবসৃষ্ট দুর্যোগ যেমন: গ্রীন হাউজ ইফেক্ট, গ্লোবাল ওয়ার্মিং, এসিড রেইন, সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি। এসব দুর্যোগের বিরূপ প্রভাব পড়ছে কৃষিতে। এই বিরূপ পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য আবিষ্কৃত হচ্ছে নিত্যনতুন পরিবেশবান্ধব কৃষি প্রযুক্তি।
স্বাধীনতার পর দেশের জনসংখ্যা ছিলো সাড়ে সাত কোটি তখন আমরা খাদ্যের যোগান দিতে পারি নি। কিন্তু এখন দেশের জনসংখ্যা প্রায় আঠার কোটি এবং প্রতি বছর ১% হারে আবাদী জমির পরিমাণ কমে গেলেও আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এর পেছনে রয়েছে কৃষিবিদদের অক্লান্ত পরিশ্রম, মেধা ও মননশীলতা এবং বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের যুগোপযোগী কৃষি নীতি। যার ফলশ্রুতিতে কৃষিতে এসেছে অভাবনীয় সাফল্য এবং বাংলাদেশ এখন ধান উৎপাদনে ৪র্থ, পাট উৎপাদনে ২য়, সবজি উৎপাদনে ৩য়, আম উৎপাদনে ৭ম, আলু উৎপাদনে ৮ম এবং ফসলের জাত উদ্ভাবনে বিশ্বে প্রথম। ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সহ বিশ্বের প্রায় ২১০ টি দেশে করোনা নামক মহামারীর প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। যার ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বাংলাদেশের সবজি উৎপাদনকারী জেলাগুলোর মধ্যে বগুড়া, জয়পুরহাট অন্যতম। এই দুটি জেলায় উৎপাদিত সবজিগুলোর মধ্যে রয়েছে আলু, কাঁচা মরিচ, বেগুল, শিম, লাউ, মূলা, শসা, ফুলকপি, বাঁধাকপি ইত্যাদি। এই অঞ্চলের কৃষকরা তাদের উৎপাদিত সবজি বিক্রি করেন ঐতিহ্যবাহী মহাস্থান সবজি হাটে যা সারা বাংলাদেশে সবজির হাট হিসেবে প্রসিদ্ধ। ঢাকা, চট্টগ্রাম সহ সারা বাংলাদেশ থেকে পাইকারি ক্রেতারা মহাস্থান হাট থেকে সবজি কিনে দেশের বিভিন্ন জেলায়া সরবরাহ করেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে করোনা নামক মহামারীর জন্য পাইকারি ক্রেতারা হাটে আসছেন না। যার প্রভাব পড়েছে সবজি বাজারে। মহাস্থান হাট সরজমিনে পরিদর্শন করে দেখা যায় বিভিন্ন সবজি অত্যন্ত স্বল্প মূল্যে বিক্রি হচ্ছে প্রতি মণ বেগুন ২৫০-৩০০/, শসা প্রতি মণ ৩৫০-৪০০/, করলা প্রতিমণ ৪০০-৫০০/, কাঁচা মরিচ প্রতিমণ ৩০০-৪০০/, মুলা প্রতি মণ ৫০-৬০/, মিষ্টি কুমড়া আকার ভেদে প্রতি পিচ ১০-১২ / দরে বিক্রি হচ্ছে। হাটে আগত কয়েকজন সবজি চাষীর সাথে কথা বলে জানা যায় বর্তমান বাজারে তারা তাদের উৎপাদিত সবজি থেকে লাভ তো দূরের কথা উৎপাদন খরচই তুলতে পারছেন না এবং এই অবস্থা চলতে থাকলে তারা অনেক বড় আর্থিক লোকসানের সম্মুখীন হবেন।
এমতাবস্থায় কৃষকের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সরকারের উচিৎ দীর্ঘমেয়াদী কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেমন কৃষি প্রধান অঞ্চলগুলোতে কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প কারখানা গড়ে তোলা, কৃষকরা যেন তাদের উৎপাদিত পণ্য সংরক্ষণ করতে পারেন এজন্য পর্যাপ্ত সংরক্ষণাগার গড়ে তোলা, মধ্যসত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ন কমানোর জন্য তথ্য প্রযুক্তিভিত্তিক বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলা যেন ঘরে বসেই কৃষক তার উৎপাদিত ফসলের মূল্য জানতে পারেন এবং সর্বোপরি যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থার আধুনিকায়নের মাধ্যমে দেশের বড় বড় শহরে অবস্থিত প্রসিদ্ধ বাজার ও সুপার মার্কেট গুলোর মধ্যে নিবিড় যোগাযোগ স্থাপন।
সর্বোপরি কৃষিপ্রধান আমাদের দেশের কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে দেশের জনসাধারণের খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা পূরণ করা এবং উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার মাধ্যমে কৃষকের মুখে হাসি ফুটে উঠবে এবং বাংলাদেশ হবে সত্যিকারের স্বপ্নের সোনার বাংলা এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করছি।
লেখক : লেকচারার, কৃষি সম্প্রসারণ শিক্ষা বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
ইমেইল: kabir38663@bau.edu.bd