ইরাকে নারীদের জীবন এমনিতেই বেশ কঠিন। জাতিসঙ্ঘ বলছে, দেশের মোট নারীদের প্রায় অর্ধেক কোনো না কোনোভাবে পরিবার বা আত্মীয়স্বজনের সহিংসতার শিকার হয়েছেন। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক অভিযানের পর ইরাকে নারী পাচারও বেড়েছে। কিন্তু সরকার এসব নারীকে রক্ষা করতে পারছে না।
ইয়ানার মোহাম্মদ হলেন এমনি এক নারী যিনি গত ১৫ বছর ধরে সহিংসতার শিকার নারীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে আসছেন। বিবিসির বিশেষ আয়োজন ‘১০০ নারী’ অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে শায়মা খলিল দেখতে গিয়েছিলেন ইরাকি নারীদের গোপন আশ্রয়কেন্দ্র।
ইয়ানার মোহাম্মদ বলছিলেন,‘আমরা যেসব নারীকে আশ্রয় দেই তাদের মধ্যে অনেককেই পরিবারের সম্মান রক্ষার জন্য হত্যা করার চেষ্টা হয়েছে। নারী পাচারকারী, কিংবা যৌনকর্মী হিসেবে তাদের কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। অনেকেই পরিবারের ভেতরে সহিংসতার মুখোমুখি হচ্ছেন। আমরা এদের রক্ষা করার চেষ্টা করছি।’
আর সে কারণেই কি এই আশ্রয় কেন্দ্রগুলোকে গোপন রাখতে হচ্ছে? তিনি বলছেন, আশ্রয় কেন্দ্রগুলোকে অবশ্যই গোপন রাখতে হবে। তার কারণ, যারা নারীদের ওপর নির্যাতন চালায়, তারা প্রায়ই তাদের অনুসরণ করার চেষ্টা চালায়।
তিনি বলেন,‘তারা এদের অপহরণ করতে চায়। হত্যা করতে চায়। আর অন্যদিকে সরকারের হাত থেকেও এদের রক্ষা করতে হবে। সরকার বলে আমাদের এই আশ্রয়কেন্দ্রগুলো অবৈধ।’
বাগদাদে এই ধরনের গোপন নারী আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে চারটি। এই আশ্রয়কেন্দ্র ঘুরে দেখার জন্য বিবিসিকে বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। তারপর গোপনে একটি কেন্দ্রে সফরের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এই আশ্রয় কেন্দ্রগুলো পরিচালনা করেন যেসব নারী, তারা নিজেরাও একসময় সহিংসতার শিকার হয়েছেন।
সাতবছর আগে বাসমাকে তার পরিবারের এক সদস্য খুন করতে চেয়েছিল। তার বাবা এবং তার গোত্রের সদস্যরা এখনও তার খোঁজ করছে। কিন্তু তারপরও তিনি এই গোপন আশ্রয়কেন্দ্রটি পরিচালনা করছেন।
কিন্তু এখানে তার নিজের কিংবা তার সাথে থাকছেন যেসব মহিলা তিনি কি কখনও তাদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত?
তিনি বলছেন,‘অবশ্যই আমি চিন্তিত। আমাদের সবার অবস্থা একই রকম। আর সেই কারণেই একে অন্যকে সাহায্য করা বেশি দরকার। কারণ আমি যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছি, এখন তারাও সেই একই পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে।
তিনি আরো বলেন,‘আমার পরিবার যদি আমাকে ধরতে পারে, তাহলে তারা আমাকে মেরে ফেলবে। এদেরও একই অবস্থা। পুলিশের কাছ থেকেও আমি ভয়ের মধ্যে আছি। যদি পুলিশ এদের ধরতে পারে, তাহলে তারা আইডি কার্ড চাইবে। কিন্তু এই নারীরা অনেকেই সেই কার্ড ছাড়াই বাড়ি থেকে পালিয়েছে।’
এসব আশ্রয় কেন্দ্রে মোট ৫২ জন বাসিন্দা রয়েছেন। কিন্তু ইরাকে যেসব নারী মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন, এই সংখ্যা তার তুলনায় খুবই নগণ্য।
পঁচিশ বছর বয়সী সালওয়া জানালেন, তিনি আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছেন ছয় বছর আগে। নিরাপত্তার স্বার্থে সালওয়ার নামধাম গোপন রাখতে হচ্ছে।
চার বছর বয়সে সালওয়ার মা মারা যায়। তারপর থেকে তিনি দুটি বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন।
তিনি বলেন, তারা তাকে নিয়মিত মারধর করতো। একবার তাদের বাসায় এক মেহমান এসেছিল। সে তার ওপর যৌন নির্যাতন চালিয়েছিল।
সালওয়া বলেন,‘আমি লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করতাম। ঐ পরিবারটি যখন বিদেশে চলে গেল, তখন আমি আরেকটি পরিবারে কাজ শুরু করি। কিন্তু আমার জীবনে কোনো পরিবর্তন এলো না। ঐ পরিবারের কর্তাও আমাকে ধর্ষণ করেছিল।’
কিন্তু সালওয়া কেন সেখান থেকে পালিয়ে গেলেন না?
‘সত্যি কথা বলতে কি আমি পালানোর কথা মোটেই ভাবছিলাম না। আমি চেয়েছিলাম আত্মহত্যা করতে। জীবনটা এমন এক পর্যায়ে নেমে গিয়েছিল যে পশুর জীবন আর সহ্য হচ্ছিল না।’
গত পাঁচ বছর ধরে অর্গানাইজেশন ফর দি উইমেন্স ফ্রিডম ইন ইরাক নামের এই প্রতিষ্ঠানটি প্রায় এক হাজার মহিলাকে নিরাপদ আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করেছে।
সালওয়া এখন বিবাহিত। তার দুটি বাচ্চা রয়েছে। যে শৈশবের স্বাদ তিনি নিজে পাননি, তার বড়ই আশা তার সন্তানেরা সেই জীবন, সেই শিক্ষার সুযোগ পাবে।
তার জীবন এখন কতখানি বদলে গেছে জানতে চাইলে সালওয়ার মুখ হাসিতে ভরে যায়।
তিনি বলেন,‘সেই পুরনো সালওয়া এখন আর নেই। আমি এখন নতুন সালওয়া। আমি এখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে। আমি এখন নিজেকে রক্ষা করতে পারি। এখন আমাকে আর চুপ করানো যাবে না।’
বাসমা, সালওয়া কিংবা অন্যান্য যারা ইরাকের এসব আশ্রয়কেন্দ্রে দিনযাপন করছেন, তারা জানেন কতটা ঝুঁকির মধ্যে তারা রয়েছেন।
বেঁচে থাকার জন্য তাদের এই লড়াই আসলে প্রতিদিনকার লড়াই।