*পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে মান্নানের অধিনায়ক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার (অব.) জহির
*পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা অবসরে গিয়ে দ্য ওয়ে ইট ওয়াজ নামে বই লেখেন
*মেজর মান্নান ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানে নেতৃত্ব দেন
*মান্নানের দাবি, এগুলো সবই গুজব, এগুলো বিতর্কিত কথা
বিকল্পধারা বাংলাদেশের মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের অনুগত ছিলেন। এমন তথ্য এসেছে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে মান্নানের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার (অব.) জহির আলম খানের লেখা বইয়ে। তাতে বলা হয়, মেজর আবদুল মান্নান মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। মেজর মান্নানের বর্তমান রাজনৈতিক সহকর্মী বিকল্পধারার সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সমশের মবিন চৌধুরীর এক সাক্ষাৎকারেও একই রকম তথ্য এসেছে।
তবে মেজর (অব.) মান্নান দাবি করেছেন, তিনি ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ বদলি হয়ে পাকিস্তানে চলে যান। সমশের মবিন চৌধুরীও এখন বলছেন, তিনি সাক্ষাৎকারে মান্নান সম্পর্কে অন্যের কাছ থেকে শোনা ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন।
স্বাধীনতার পর পাকিস্তান থেকে দেশে ফেরেন মেজর মান্নান। এরপর ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপির হাত ধরে প্রতিমন্ত্রী হন তিনি।
ব্রিগেডিয়ার জহির আলম খান (জেড এ খান) ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৪ ডিভিশনের অধীন ৩ কমান্ডো ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক ছিলেন। তিনি ২৫ মার্চ কালরাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার অভিযানে পাকিস্তান সেনাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পাকিস্তানি এই সেনা কর্মকর্তা পরে অবসরে গিয়ে দ্য ওয়ে ইট ওয়াজ নামে বই লিখেছেন। বইটি বিগত শতকের নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে পাকিস্তানের করাচি থেকে প্রকাশিত হয়।
বইটিতে ব্রিগেডিয়ার জেড এ খান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। জেড এ খানের অধীন ছিল তিনটি কোম্পানি। এর মধ্যে হামজা কোম্পানির নেতৃত্বে ছিলেন মেজর আবদুল মান্নান (দ্য ওয়ে ইট ওয়াজ, পৃষ্ঠা-২৪৩)।
জেড এ খান লিখেছেন, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সকালে তাঁকে মেজর জেনারেল আবুবকর ওসমান মিঠা জানান যে চট্টগ্রাম বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কোনো যোগাযোগ নেই। মেজর জেনারেল মিঠা জেড এ খানকে নির্দেশ দেন দুই প্লাটুন সেনা নিয়ে চট্টগ্রাম যাওয়ার জন্য। সেই অভিযানে অংশ নেওয়া সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে মেজর মান্নানও ছিলেন।
জেড এ খান লিখেছেন, ‘আমি আমার ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরে টেলিফোন করে আমার অ্যাডজুট্যান্টকে চট্টগ্রাম যেতে অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ ৬০ জন সেনাসদস্যকে ব্রিগেড সদর দপ্তরে হাজির করার নির্দেশ দিই এবং কোম্পানি কমান্ডার মেজর মান্নানকেও এ দলে অন্তর্ভুক্ত করতে বলি।’ (পৃষ্ঠা–২৭১)
বইয়ে বলা হয়, চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রের সম্প্রচারযন্ত্র (ট্রান্সমিটার) হয় দখল নতুবা ধ্বংস করে দেওয়ার নির্দেশ আসে তাঁর কাছে। মেজর জিয়াউর রহমান (প্রয়াত রাষ্ট্রপতি) ওই সম্প্রচারযন্ত্র ব্যবহার করে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেছিলেন। তিনি তখন বিদ্রোহী সেনাদের নিয়ে চট্টগ্রাম নিয়ন্ত্রণ করছেন। ৫০ জন কমান্ডো ওই সম্প্রচারযন্ত্র ধ্বংসের অভিযানে অংশ নেয়। এ দলের নেতৃত্বে ছিলেন মেজর মান্নান।
অভিযানে মেজর মান্নানকে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণ সম্পর্কে জেড এ খান লেখেন, ‘মেজর মান্নানকে নেতৃত্ব দেওয়া হলো, কারণ তিনি জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এবং বাংলায় কথা বলেন। আমি তাঁকে কমিশন্ড হওয়ার সময় নেওয়া শপথের কথা স্মরণ করিয়ে দিলাম এবং বললাম, এই শপথ পালন করার এটাই উপযুক্ত সময়।’ (পৃষ্ঠা–২৭৯)
এরপর ওই কমান্ডো দল যথাস্থানে পৌঁছার পর সম্প্রচারযন্ত্রটির অবস্থান অনুসন্ধান শুরু করেন মেজর মান্নান। কিছু দূর অগ্রসর হওয়ার পর স্বাধীনতাকামী সেনাসদস্যদের একটি দল কমান্ডো বাহিনীর সামনে পড়ে যায়। মেজর মান্নান তাদের একজনের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ওই ব্যক্তির হাতে থাকা স্টেনগান ধরে ফেলেন। প্রায় একই সময় ওই ব্যক্তি গুলি চালান। এতে মেজর মান্নান হাতের তালুতে গুলিবিদ্ধ হন। (পৃষ্ঠা-২৭৯)। এরপর কোণঠাসা হয়ে পড়ে পাকিস্তানি কমান্ডো বাহিনী। পরে পাকিস্তান বাহিনীর বিমান হামলায় সম্প্রচারযন্ত্রটি ধ্বংস হয় বলে দাবি করেছেন ব্রিগেডিয়ার জেড এ খান।
জেড এ খানের বইয়ে বলা হয়, ‘গুলিবিদ্ধ হওয়ায় মেজর মান্নানকে চট্টগ্রামে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের সেনা কর্মকর্তারা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, তাঁদের প্রত্যেকেই হয় গ্রেপ্তার করেছেন কিংবা গ্রেপ্তার করতে চেয়েছেন। আমার কাছে বেশ কয়েকটি খবর আসে যে তাঁকে হয়রানি করা হচ্ছে। এই অবস্থায় আমি জেনারেল মিঠাকে অনুরোধ করি যে মেজর মান্নানকে পশ্চিম পাকিস্তানে বদলি করা হোক। পরে তাঁকে চেরাটে (পাকিস্তান) পাঠিয়ে দেওয়া হয়।’ (পৃষ্ঠা-২৮১)।
তবে মেজর (অব.) আবদুল মান্নান গত ২৭ নভেম্বর প্রথম আলোকে বলেন, ‘এগুলো সবই গুজব। আমি কমান্ডোর নেতৃত্বে ছিলাম নাকি? আমেরিকায় একটি কোর্স করার জন্য আমাকে ফেব্রুয়ারিতে বদলি করা হয়। আর্মি অ্যাকশন শুরু হওয়ার পর আমাকে পাকিস্তানে বদলি করা হয়। ফ্লাইট না পাওয়ায় তাৎক্ষণিক যেতে পারিনি। আমি ২৮ মার্চ চলে যাই। সুতরাং আমি তো ছিলামই না। কমান্ডো ফোর্সের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক ছিল না।’
ব্রিগেডিয়ার জেড এ খানের বইয়ে থাকা তথ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে মেজর মান্নান বলেন, ‘তিনি উল্টো বলেছেন। ওখানে কোনো বাঙালিকে নেতৃত্ব দেওয়া হয় নাই। আমি তো চলেই গিয়েছিলাম। সুতরাং এগুলো বিতর্কিত কথা।’ তিনি বলেন, ‘বইটা সম্পর্কে আমি শুনেছি। আমার কাছে কপি নাই। ইন মার্চ আই ওয়াজ পোস্টেড আউট। ২৬ তারিখ ঢাকায় আসি, ২৭ তারিখ ঢাকায় থেকে ২৮ মার্চ আমি চলে যাই। কাজেই এসব বিতর্কিত কথা।’
তবে লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের বই আওয়ামী লীগ: যুদ্ধদিনের কথা ১৯৭১-এ মেজর মান্নান প্রসঙ্গ এসেছে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সমশের মবিন চৌধুরীর এক সাক্ষাৎকারে। বইটি প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালে। সমশের মবিন চৌধুরীর সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয় ২০১৬ সালের ১৮ জানুয়ারি। তিনি সম্প্রতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারায় যোগ দেন এবং দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হন।
সমশের মবিন সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ইন্ডিয়ান রেডিও বলছে, পূর্ব বাংলায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। রেডিও পাকিস্তানকে তো বিশ্বাস করার কোনো কারণ নাই। ৩০ তারিখ (মার্চ) ভোরে চকবাজারে আমরা গুলির আওয়াজ শুনেছি। এত কাছে তো পাকিস্তান আর্মি আসার কথা না! ২৯ তারিখ পাকিস্তান আর্মির একটি কমান্ডো ইউনিট ল্যান্ডেড ইন আনোয়ারা, লেড বাই মেজর মান্নান (পরে বিএনপির নেতা, প্রতিমন্ত্রী)। লে. মাহফুজ যখন ফায়ার করা শুরু করল, ওখানেই পাকিস্তানের কিছু লোক মারা যায়, অন দ্য স্পট। বাকি লোক পালিয়ে যায়। মান্নান পালিয়ে যায়। মাহফুজই পরে বলেছিল, “মান্নান তো আমারে মেরেই ফেলেছিল”।’ (আওয়ামী লীগ: যুদ্ধদিনের কথা ১৯৭১; পৃষ্ঠা-৯৬)
তবে সমশের মবিন চৌধুরী গত ২৪ নভেম্বর এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি কিন্তু ওইভাবে বলিনি। শোনা গিয়েছিল যে মেজর মান্নান সহযোগিতা করেছিলেন। এটা মাহফুজের (লে. মাহফুজ) কথা। মাহফুজের কথাটাই আমি (মহিউদ্দিন আহমদকে) বলেছি।’
জেড এ খানের লেখা সম্পর্কে সমশের মবিন চৌধুরী বলেন, ‘মেজর মান্নানকে ওই অভিযান স্যাবোটাজ করার জন্য যে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তা তো তিনি লেখেননি। তিনি কেবল একটি দিক নিয়ে লিখেছেন। মান্নানকে গ্রেপ্তার করে ঢাকায় সেনা কারাগারে রাখা হয়েছিল। তারপর তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।’ অবশ্য গ্রেপ্তার ও সেনা কারাগারে থাকার কথা মেজর মান্নান প্রথম আলোকে বলেননি।
সমশের মবিনের এই ভাষ্য সম্পর্কে লেখক মহিউদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি সমশের মবিন চৌধুরীর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতেই বইয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। একই দলের রাজনীতিক হওয়ায় বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে সমশের মবিন চৌধুরী এখন এই কথা বলছেন।