মহান আল্লাহতায়ালা ইমানদারদের আখলাকি আমলি উৎকর্ষের জন্য দিনক্ষণ, স্থান, কাল ও যুগ হিসেবে অনেক বরকতময় দিবস-রজনি ও ইবাদতের সুবর্ণ সুযোগ দান করেছেন। ইবাদতের এসব উর্বর সময়কে বান্দা যথাযথভাবে ঐকান্তিকতার সাথে কাজে লাগাতে পারলে সামান্য সাধনা, ক্ষুদ্র পরিশীলন ও অনুশীলন দ্বারা প্রশান্তির বারিধারায় সিক্ত হয়ে অর্জন করতে পারবেন মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি। এমনি অন্যতম রজনি হলো পবিত্র শবেবরাত। রাসূল সা:-এর ভাষায়, ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’। অর্থাৎ শাবান মাসের ১৫তম রজনি। বিখ্যাত সাহাবি হজরত মু’আজ ইবনে জাবাল রা: সূত্রে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ সা: এরশাদ করেন, অর্ধ শাবানের রাতে অর্থাৎ শাবান মাসের ১৪ তারিখ রাতে মহান আল্লাহতায়ালা সমগ্র সৃষ্টিকুলের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও হিংসুকবিদ্বেষী লোক ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ : ১৩৯০, সহিহ ইবনে হিব্বান : ৫৬৬৫)।
হজরত আসিম ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবি বকর তার পিতার সনদে দাদা হজরত আবু বকর রা: থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল সা: এরশাদ করেন, আল্লাহতায়ালা শাবানের ১৫তম রাতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং সব পাপীকে (যারা ক্ষমা প্রার্থনা করে) ক্ষমা করে দেন। তবে মুশরিক (আল্লাহর সাথে সমকক্ষ সাব্যস্তকারী) ও মুশহিন (হিংসুক) ছাড়া। (বায়হাকি : ৩৮৩৫)।
হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রা:, আবু সালাম আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা:, আবু মুসা আশআরী রা:, আবু হুরায়রা রা:, আবু বকর রা:, আউফ ইবনে মালিক রা: ও হজরত আয়েশা রা: সবাই এ হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। হাদিস বিশারদরা ওই হাদিসের রাবিদেরকে ছেক্বাহ তথা বিশ্বস্ত বলেছেন। মূল কথা হাদিসটি ‘সহিহ’। (আত তারগিব ওয়াত তারহিব : ২ খণ্ড,পৃষ্ঠা : ১১৮)।
এ রাতে করণীয় সম্পর্কে এরশাদ হয়েছে, হজরত আলী বিন আবু তালিব রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: এরশাদ করেন- অর্ধ শাবানের রাত যখন হয়, তোমরা রাতটি ইবাদত-বন্দেগিতে পালন করো এবং দিনে রোজা রাখো। কেননা, এ রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তায়ালা প্রথম আসমানে এসে বলেন, কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছো কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দেবো। কোনো রিজিক অন্বেষণকারী আছো কি? আমি তাকে রিজিক প্রদান করব। আছো কি কোনো রোগাক্রান্ত? আমি তাকে আরোগ্য দান করব। এভাবে সুবহে সাদেক পর্যন্ত আল্লাহতায়ালা মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে তাদের ডাকতে থাকেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ : ১৩৮৮)।
মহিমান্বিত এ রাত অশেষ ফজিলতের। হজরত আলা ইবনুল হারিস রা: থেকে বর্ণিত, হজরত আয়েশা রা: বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ সা: রাতে নামাজে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সেজদা করেন যে, আমার ধারণা হলো তিনি হয়তো মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ করে বললেন, হে আয়েশা, তোমার কি এই আশঙ্কা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না, ইয়া রাসূলুল্লাহ। আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার এই আশঙ্কা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না। তখন নবী সা: জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি জানো এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তার রাসূলই ভালো জানেন। রাসূলুল্লাহ সা: তখন এরশাদ করলেন, ‘এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত (শবেবরাত)। আল্লাহ তায়ালা অর্ধ-শাবানের রাতে তার বান্দার প্রতি মনোযোগ দেন এবং ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহপ্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই। (বায়হাকি : ৩৮২, তাবরানি : ১৯৪)।
শবেবরাতের আলাদা কোনো নামাজ নেই। নির্দিষ্ট সূরা দিয়ে নির্দিষ্ট রাকাত নামাজ পড়ার রীতি ভুল প্রচলন। এটা থেকে বেঁচে থাকা দরকার। পারলে সারা রাত ইবাদত-বন্দেগি করা। সেটা হতে পারে কুরআন তেলাওয়াত, জিকির, নফল নামাজ, দোয়া-দরুদ, তওবা-ইস্তেগফার, দান-সদকা, উমরি কাজা নামাজ, কবর জিয়ারত ইত্যাদি। তবে দলবদ্ধ ছাড়া একাকীভাবে কবর জিয়ারতে কোনো সমস্যা নেই। রাসূল সা: চুপিসারে একাকী জান্নাতুল বাকিতে কবর জিয়ারত করেছেন। আয়েশা সিদ্দিকাকে রা: নিদ্রা থেকে জাগ্রত করেননি। হজরত আয়েশা রা: বলেন, এক রাতে হজরত রাসূল সা:কে না পেয়ে খুঁজতে বের হলাম। খুঁজতে খুঁজতে জান্নাতুল বাকিতে গিয়ে আমি তাকে দেখতে পেলাম। তিনি বললেন, কী ব্যাপার আয়েশা? তোমার কি মনে হয় আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল তোমার ওপর কোনো অবিচার করবেন? হজরত আয়েশা রা: বললেন আমার ধারণা হয়েছিল আপনি অন্য কোনো বিবির ঘরে গিয়েছেন। রাসূল সা: তখন বললেন, যখন শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাত আসে, তখন আল্লাহ তায়ালা এ রাতে প্রথম আসমানে নেমে আসেন। তারপর বনু কালব গোত্রের বকরির পশমের চেয়ে বেশি সংখ্যক বান্দাদের ক্ষমা করে দেন। (সুনানে তিরমিজি : ৭৩৯)।
সম্ভব হলে পরদিন অর্থাৎ ১৫তম দিনে একটি নফল রোজা রাখা। কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিকতা ও জামাত ছাড়া একাকীভাবে সামর্থ্য অনুযায়ী নফল ইবাদত-বন্দেগি করা। তবে হ্যাঁ, কোনো প্রকার ঘোষণা ছাড়া, প্রস্তুতি ছাড়া কিছু মানুষ একত্র হয়ে গেলে সমস্যা নেই। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে, যেসব ইবাদত সমবেতভাবে আদায় করার প্রচলন রাসূল সা: থেকে প্রমাণিত, তা সমবেতভাবে আদায় করা। বাকিগুলো একাকী করা। ইসলামী স্কলারদের মতে, আল্লাহতায়ালা নফল ইবাদত নীরবে পালনকারীকে বেশি ভালোবাসেন। আর ইখলাসের সাথে স্বল্প আমল ঐকান্তিকতাহীন বেশি আমল থেকে উত্তম।
শবেবরাত উপলক্ষে হালুয়া-রুটির ব্যবস্থা, মসজিদে তাবারুকের আয়োজন, মরিচ বাতি, অতিরিক্ত আলোকসজ্জা, রাস্তাঘাটে অযথা ঘোরাঘুরি করা, চায়ের দোকানে আড্ডা এসব কর্মকাণ্ড এ রাতের আধ্যাত্মিক আবহকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। শরিয়তে এসব কাজের কোনো ভিত্তি নেই। এগুলো অবশ্যই বর্জন করতে হবে। মহিমান্বিত রজনিতে আমাদের সবার উচিত নিজের যাবতীয় গোনাহের জন্য তাওবা করে রাব্বুল আলামিনের দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করা। মনের নেক আশা-আকাঙ্খা পূরণে ও মৃতদের মাগফেরাতের জন্য বেশি বেশি দোয়া করা। দান সদকাসহ নফল আমলের মাধ্যমে ভেজা চোখে মুনাজাতে রাত কাটানো। ইবাদতে প্রশান্ত হওয়ার রাতটি ভেজা চোখে মুনাজাতে কাটাতে পারলে আল্লাহ তায়ার রহমতের ধারা নেমে আসবে ইনশাআল্লাহ।
লেখক : মুফতি, শিক্ষক ও সাংবাদিক