করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কার কত দূর?

নভেল করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কার নিয়ে বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানীদের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার মধ্যে আশা-নিরাশায় দোল খাচ্ছে কোটি কোটি মানুষের বেঁচে থাকার স্বপ্ন। আকস্মিক এই অণুজীবের আক্রমণে দিশেহারা সবাই। পৃথিবীর যেসব দেশ বিজ্ঞান গবেষণায় কোটি কোটি ডলার খরচ করে তাদের অবস্থা সবচেয়ে সঙ্গীন।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ভাইরাসের টিকা কিংবা প্রতিষেধক আবিষ্কারে তাদের আরো সময় লাগবে। তাদের কেউ কেউ মনে করেন, এই রোগের টিকা আবিষ্কারে এক বছর লাগতে পারে। আবার অনেকের মতে, দু’বছরও লাগতে পারে।

রোগটির উৎপত্তিস্থল হিসেবে চিহ্নিত চীনের বিজ্ঞানীরা ভাইরাসটির বৈজ্ঞানিক কোড অতিদ্রুত জানিয়ে দিয়েছেন। ফলে গবেষণাকাজটি সব বিজ্ঞানীর জন্য সহজ হয়েছে। যেসব দেশে এই রোগের প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি সেখানে স্থানীয় পর্যায়েও এ নিয়ে গবেষণার শেষ নেই। জাপান রোগটি নিরাময়ে স্থানীয়ভাবে একটি ইনফ্লুয়েঞ্জার ওষুধ ব্যবহার করে ভালো ফল পেয়েছে বলে জানিয়েছে।

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস নিয়ে গুজব-কুসংস্কারও কম হয়নি। আমেরিকা-ব্রিটেনের মতো দেশে এই রোগের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় গরম পানি দেদার খাওয়া চলছে। এই ভাইরাসটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তা মানবদেহে প্রবেশের সাথে সাথে নিজের জিনগত বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে ফেলছে। ফলে তা শক্তিশালী ও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে। বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনের ফলে প্রতিষেধক আবিষ্কারে সময় লাগছে। অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানীরা বলেছেন, তারা একটি প্রতিষেধক পরীক্ষামূলক প্রয়োগের পর্যায়ে রয়েছেন।

আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী এবং বিজ্ঞানবিষয়ক ওয়েবসাইটগুলোতে যে তথ্য দেয়া হয়েছে, তাতে বর্তমানে ২০টিরও বেশি প্রতিষেধক প্রাণী দেহে প্রয়োগের কাজ চলছে। কোভিড-১৯ একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও মারাত্মক আগ্রাসী ধরনের ভাইরাস হওয়ায় ওষুধ আবিষ্কারে সময় লাগছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভাইরাস থেকেই সাধারণত এন্টি ভাইরাস প্রতিষেধক আবিষ্কার করা হয়। হাম, যক্ষ্মা, গুটিবসন্ত ও মামস ইত্যাদি প্রাণঘাতী রোগের টিকা কিংবা প্রতিষেধক এভাবেই আবিষ্কৃত হয়েছে। এই সূত্র ধরেই তারা করোনাভাইরাসের টিকা কিংবা প্রতিষেধক ওষুধ আবিষ্কারের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।

এ পর্যন্ত অগ্রগতি যতটুকু তাতে চলতি বছরের মধ্যে একটি প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হলেও প্রাণীদেহে প্রয়োগের পর তার ফলাফল পেতে সময় লাগবে। তারপরও এই ভাইরাসে আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে তা প্রয়োগে ফলাফল জানতে আরো বেশি সময় লেগে যেতে পারে। তারা বলছেন, বয়স্ক ব্যক্তিরা তাদের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দিয়ে এই ভাইরাসের সাথে পেরে উঠছে না। ফলে মৃত্যুর হার বয়স্কদের মধ্যেই বেশি। এখন ওষুধ আবিষ্কৃত হলেও তা বয়স্কদের মধ্যে কেমন কাজ করবে তা আগে থেকেই আন্দাজ করা মুশকিল। সব মিলিয়ে বিজ্ঞানীরা বিশ্বব্যাপী যেভাবে কাজ করছেন তাতে আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে হয়তো রোগের প্রতিষেধক পাওয়া যাবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়ো টেকনোলজি বিভাগের প্রফেসর বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. আনোয়ারুল আজীম আখন্দ গতকাল বৃহস্পতিবার এ প্রসঙ্গে জানান, কোভিড-১৯ ভাইরাসটি একটু জটিল প্রকৃতির। কিন্তু বিজ্ঞান তো থেমে নেই। যত জটিলই হোক প্রতিষেধক আবিষ্কারও থেমে থাকবে না। হয়তো এখানে একটু সময় লাগছে। তিনি বলেন, এই ভাইরাসটি মানবদেহে ঢুকেই তার বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে ফেলছে। তাই কিভাবে সে ঘায়েল হবে তা বের করতে সময় লাগছে। তিনি বলেন, সতের থেকে আঠার শতকে গুটিবসন্তে কত মানুষের প্রাণ গেছে। তার ওষুধ আবিষ্কৃত হতে ১০০ বছর লেগেছে। আশির দশকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এই প্রাণঘাতী রোগ নির্মূলের কথা ঘোষণা করেছে। আমি আশাবাদী। কোভিড-১৯ এরও প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হবে।

বিজ্ঞানী আনোয়ারুল আজীম বলেন, সমস্যা হচ্ছে দ্রুত বিস্তার নিয়ে। আগে এসব প্রাণঘাতী মহামারী স্থানীয় পর্যায়ে সীমিত থাকত। তখন একস্থান থেকে আরেকস্থানে ছড়াত না কারণ মানুষ দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে পারত না। এখন বিশ্বের একস্থান থেকে আরেক স্থানে ছড়াতে মাত্র দুই দিনের প্রয়োজন হয়। সমস্যা এখানেই।

তিনি বলেন, আইসোলেশন (বিচ্ছিন্ন থাকা) খুব বেশি প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষ বিষয়টি বুঝতে চায় না। এখন ঘরে বসে থাকাটাই সবচেয়ে বড় সতর্কতা হিসাবে কাজ করবে। এমনকি যার সংক্রমণ নেই তাকেও ঘরে থাকতে হবে। আর বেশি পরিমাণে পরীক্ষা করতে হবে। আমাদের এ ক্ষেত্রে সক্ষমতা কম থাকায় সময় লাগছে। তিনি বলেন, মানুষ এ রোগে সংক্রমিত হলেই কিন্তু মারা যাবে না। কিন্তু কিছু মানুষ তো এই ভাইরাসের কাছে পরাজিত হবে। তাদেরই ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। এখন এটা তো আগে থেকে জানা যাবে না। এ কারণেই সবাইকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আইসোলেশনে থাকতে হবে।

ড. আজীম জানান, আমাদের দেশে একটি ভালো দিক রয়েছে। সেটা হলো এখানে মানুষ অধিক পরিমাণে অণুজীবের মধ্যে বাস করে। ফলে মানুষের দেহকোষের মধ্যেই এক ধরনের ইমিউন ক্যাপাসিটি বা প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়ে আছে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, আমাদের দেশে বহু মানুষ খোলা ট্যাপের কলের পানি খায়। এই পানি খেয়েও দিব্যি ভালো থাকে। এই পানি অনেক দেশের নাগরিক আছেন যারা খেলেই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে যাবেন। বিচিত্র মাইক্রো অর্গানিজমের ভেতর বাস করে এখানকার মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতাটা বেশি। ফলে এখানে ম্যাচিভ (ব্যাপক) আকারে এটা ছড়িয়ে পড়বে বলে আমি মনে করি না। তবে তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, সংক্রমণের পর্যায় এবং লেভেল না বুঝে আপনি কিছুই বলতে পারবেন না। আর এ কারণেই সবাইকে আইসোলেশনে থাকতে হবে। আর ব্যাপক মাত্রায় পরীক্ষা করতে হবে। তিনি বেশি আক্রান্ত দেশগুলোর নাগরিকদের ইমিউন ক্যাপাসিটির দুর্বল দিকের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, তবে সেখানেও কিন্তু বয়স্করাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তারাই মারা যাচ্ছে বেশি সংখ্যায়।

প্রফেসর আনোয়ারুল আজীম বলেন, ভাইরাসের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তা মানবদেহে প্রবেশ করার পর তার বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধ জোরদার হয় এবং আস্তে আস্তে সেটি পরাস্ত হয়। কিন্তু এ জন্য সময় লাগে। সে সময়ের আগেই যা ক্ষতি সেটা হয়ে যায়। কোভিড-১৯ এর প্রতিষেধক কিংবা এন্টিবডির কার্যক্রম শুরুর আগে তাই সতর্কতার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রফেসর বিশিষ্ট অণুজীব বিজ্ঞানী ড. মাহমুদা ইয়াসমিনের কাছে। এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, নভেল করোনা ভাইরাসটির চরিত্র কিছুটা জটিল। এর প্রতিষেধক আবিষ্কার নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, এখন প্রথমদিকে ক্ষতিটা বেশিই হচ্ছে। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। তবে সময়ের ব্যবধানে এর প্রতিষেধক আবিষ্কার হবে। তিনি বলেন, নানান কারণে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ইমিউনিটি (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা) বেশি। এর প্রমাণ আছে। তা ছাড়া যেসব দেশে মানুষের দেহে বিসিজি টিকা দেয়া আছে সেখানেও আক্রান্তের হার তুলনামূলকভাবে কম বলে এক রিপোর্টে উঠে এসেছে। এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, আগে থেকেই টিকা দেয়ায় শরীরে এক ধরনের প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়ে আছে। নতুন কোনো ভাইরাস দেহে অনুপ্রবেশ করলে স্বাভাবিকভাবেই তা প্রতিরোধের মুখে পড়বে। করোনাভাইরাসের যে টিকা আবিষ্কারের চেষ্টা বিজ্ঞানীরা করছেন তাও তো একটি এন্টি বডি তৈরির সূত্র ধরেই। প্রফেসর মাহমুদা এরপরও সবাইকে সতর্কতা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার আহ্বান জানিয়ে বলেন, এই মুহূর্তে এর চেয়ে বড় কোনো দাওয়াই আর নেই।

Share this post

scroll to top