সিইসির নির্দেশ যেন একতরফা নির্বাচনের গোপন ছক : রিজভী

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে আওয়ামী লীগ একক প্রচারণা চালালেও সারাদেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের গ্রেফতার অব্যাহত রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করছেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

তিনি বলেন, প্রশাসন ও পুলিশে কর্মরত বিতর্কিত ও দলবাজ কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে গতকাল নির্বাচন কমিশনের বরাবরে আবেদন করলে সিইসি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সভায় বলেছেন কোনো কর্মকর্তাকে বদলী করা হবে না। রিজভী বলেন, বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে বিতর্কিতদের সরানোর আহবানের বিপরীতে সিইসির এ ধরনের বক্তব্যে দলবাজ কর্মকর্তাদের আরো বেপরোয়া করে তুলবে।

রিজভী বলেন, গতকাল নির্বাচন ভবনে উচ্চপদস্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে নির্বাচন কমিশনের বৈঠকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদার নির্দেশসমূহ এবং উপস্থিত কিছু পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্যে মনে হয় উভয় পক্ষই সরকারের অনুকূলে একতরফা নির্বাচনেরই একটা গোপন ছক তৈরি করে রেখেছে।

আজ শুক্রবার নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন রিজভী।

লিখিত বক্তব্যে রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘দেশজুড়ে গ্রেফতার, হামলা-নির্যাতন থামছেই না। এখনো আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু না হলেও আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা এলাকায় এলাকায় মাইকিং করে মাঠে ময়দানে সভা-সমাবেশ করে যাচ্ছে, নৌকার পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছে। গতকাল নারায়ণগঞ্জে শামীম ওসমান বিশাল প্রচারণা সভা করেছে, কিশোরগঞ্জের ভৈরবে নাজমুল হাসান পাপনের পক্ষে মাইকিং করে সমাবেশ অব্যাহত রেখেছে। এছাড়া সকল জেলা, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ মিছিল করে, সমাবেশ করে নৌকার পক্ষে ভোট চাচ্ছে। অন্যদিকে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের এলাকায় যেতে বাধা দিচ্ছে পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। ঘরোয়া বৈঠক করতে চাইলে সেখানে চলছে সশস্ত্র হামলা। বিএনপির লোক ঘরের ভিতর সভা করতে পারছেন না অথচ আওয়ামী লীগ নির্বাচন কমিশনের চোখের সামনে বড় বড় সমাবেশ করছে, নৌকার পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছে। নির্বাচনী বিধি ভঙ্গ করে সারাদেশ আওয়ামী লীগের ফেস্টুন, ব্যানার ও পোস্টারে ছেয়ে গেছে।’

তিনি বলেন, ‘এর আগে পুলিশ কমিশনার বলেছিলেন যে, তফসিল ঘোষণার পর গায়েবী মামলা দেয়া হবে না, অথচ এখন অব্যাহতভাবে গায়েবী মামলা দায়ের করা হচ্ছে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। এই বৈঠকে একজন নির্বাচন কমিশনার সারাদেশে পুলিশের দায়ের করা গায়েবী মামলা দায়েরের বিষয়ে তুমুল আপত্তি তুললেও সেটিকে গ্রাহ্য করা হয়নি। বৈঠকের কিছুক্ষণ আগে পুলিশের কিছু বিতর্কিত দলবাজ কর্মকর্তাদের একটি তালিকা বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল নির্বাচন কমিশনে জমা দিলেও প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ তো গ্রহণ করেনইনি, বরং বৈঠকে উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তাদের আশস্ত করে বলেন যে, আপনাদের প্রতি আমাদের বিশ্বাস আছে। আপনারা আতঙ্কিত হবেন না। উক্ত বৈঠকে বেশ কয়েকজন এসপি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পাইকারী বদলীর দাবির বিষয়ে সিইসি’র মনোযোগ আকর্ষণ করলে সিইসি তাদেরকে নিশ্চয়তা দেন যে, তদন্ত ছাড়া বদলী করা হবে না। আরেকজন এসপি বলেছেন, বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্ট যেভাবে সংগঠিত হচ্ছে তাতে তারা ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠবে এবং সেক্ষেত্রে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে। একজন এসপির এধরনের বক্তব্যে নির্বাচন কমিশনারবৃন্দ কোনো মন্তব্য করেননি। আরো কয়েকজন এসপি তাদের বক্তব্যে বলেছেন- তাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য আছে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা কিছু নির্দিষ্ট কেন্দ্রে গোলযোগ সৃষ্টি করবে। এ সম্পর্কে নির্বাচন কমিশন তাদেরকে সতর্ক থাকতে বলেন।’

রিজভী বলেন, ‘অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়-বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের বিরুদ্ধে গতকাল নির্বাচন কমিশন ও পুলিশ কর্মকর্তারা একজোট হয়ে বৈঠক করেছেন। বৈঠকের আলোচনায় মনে হয়- বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্টকে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন থেকে কিভাবে দমন করে চাপিয়ে রাখা যায়, তারই মহাপরিকল্পনা হয়েছে সেখানে। তাদের আলোচনায় এটি অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে, দলীয় চেতনায় সাজানো পুলিশ কর্মকর্তাদের কোনো নড়চড় করবেন না নির্বাচন কমিশন। অর্থাৎ সরকারের অনুকূলেই সমতল ভূমি নির্মাণ করতে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে ইসি। আর সেইক্ষেত্রে পুলিশ অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করবে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন যাতে না হয়। কারণ সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ঐক্যফ্রন্টের বিজয় ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।’

তিনি বলেন, ‘কোনো দল বা জোট কতটা সংগঠিত হচ্ছে, এটার জন্য পুলিশের এতো মাথাব্যথা কেনো? সতর্ক নজর রাখতে হবে কেনো? রাজনৈতিক দলের কাজই তো জনগণকে সংগঠিত করা। কেনো সেই এসপি ক্ষমতাসীনদের হাতে বৈধ-অবৈধ অস্ত্রের স্তূপের কথা বলেননি? প্রতিদিন প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীন দলের নি¤œ পর্যায়ের নেতাকর্মী কর্তৃক নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের পরও কেনো নির্বাচন কমিশন ও পুলিশ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি? গতকাল প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্য পুলিশের ভয়ঙ্কর দমনের প্রবণতাকে উস্কে দিবে। বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের লাশ নদীতে ভেসে উঠছে, মিথ্যা মামলায় কারাগারে পাঠানো হচ্ছে, গ্রেফতার করা হচ্ছে, হামলা করা হচ্ছে, রিমান্ডে পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে, আর গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড সরকারের দৈনন্দিন কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে। অথচ এসব বিষয়ে তো কোনো পুলিশ কর্মকর্তা সেখানে কোনো বক্তব্য উত্থাপন করেননি।’

রিজভী বলেন, “নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে সরকার সকল সরকারী প্রতিষ্ঠানকে নির্লজ্জভাবে ব্যবহার করছে। এই ব্যবহার হচ্ছে বেপরোয়া ও নির্বিচারভাবে। প্রধানমন্ত্রীর নাম ব্যবহার করে ‘বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংক’ সদস্য ব্যাংকগুলোর কাছে আগামী ১২ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রায় একশো কোটি টাকার কম্বল দাবি করেছে। গত ২০ নভেম্বর ব্যাংক অ্যাসোসিয়েশনের এক সভায় সিদ্ধান্তের বরাত দিয়ে আগামী ২৭ নভেম্বর গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে নমূনা কম্বল এবং পরের পনের দিনের মধ্যে পুরনো ব্যাংকগুলোর কাছে ৫০ হাজার এবং নতুন ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ১৫ হাজার কম্বল চাওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর নাম ব্যবহার করে ত্রাণের নামে ব্যাংকগুলোর কাছে কম্বল দাবি নির্বাচনী আচরণবিধির পুরোপুরি লঙ্ঘন। প্রধানমন্ত্রীর বরাত দিয়ে ব্যাংক মালিকগুলোর কাছে চিঠি পাঠানোর ফলে কেউ মুখ খুলতেও সাহস পাচ্ছে না। নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করছেন প্রধানমন্ত্রী। আমরা এর নিন্দা ও ধিক্কার জানাই।”

দেশজুড়ে চলমান গ্রেফতার প্রসঙ্গে রিজভী বলেন, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক এমপি গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মিথ্যা মামলায় গতকাল জামিন নিতে গেল তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। নির্বাচনের প্রাক্কালে জামিনযোগ্য মামলায় জামিন না দিয়ে গি. কা. চৌধুরীকে কারাগারে প্রেরণ বিএনপিকে নির্বাচন থেকে সরানোরই সরকারের একটি অপকৌশল। আমি তাকে কারাগারে প্রেরণের ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি, অবিলম্বে তার মুক্তি দাবি করছি।

তিনি বলেন, ‘বিএনপির কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহসানুল হক মিলনকে গতরাতে গোয়ানীবাগান চট্টেশ^রী রোড, চকবাজার চট্টগ্রামে এক বন্ধুর বাসা থেকে গ্রেফতার করেছে ডিবি পুলিশ। তাকে এখন চাঁদপুর ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমরা গত পরশুদিনই এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছিলাম যে, এহসানুল হক মিলনকে পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছে। এজন্য তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। গতকাল তাকে ডিবি পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার করা হয়েছে শুধু নির্বাচন থেকে দূরে রাখার জন্য। মহিউদ্দিন খান আলমগীরের ক্রোধ মেটানোর জন্যই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাকে গ্রেফতারের ঘটনায় আমি তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং অবিলম্বে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করে নিঃশর্ত মুক্তির জোর দাবি জানাচ্ছি।’

রিজভী বলেন, ঢাকা মহানগরীরর রূপনগর থানা বিএনপি নেতা মো: আবুল কাশেম, মোহাম্মদপুরে আব্দুর রহমান ও মো; মাসুম, মুন্সীগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের হুমায়ুন আহমেদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানার যুবদলের সুমনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। নেতাকর্মীদেরকে গ্রেফতারের ঘটনায় আমি তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং অবিলম্বে তাদের মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারসহ নিঃশর্ত মুক্তির জোর দাবি করছি।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top