২১শে ফেব্রুয়ারি, রক্তের বিনিময়ে বর্ণমালা ছিনিয়ে নেওয়ার দিনটি কীভাবে পালন করলেন বাংলাদেশে ব্রাত্য, মাতৃভূমি থেকে দু-যুগের বেশি সময় ধরে নির্বাসিত লেখক তসলিমা নাসরিন?
স্পষ্টভাবে বললে দুধের স্বাদ জীবনেও ঘোলে মেটে না। কিন্তু নিজের মন; আত্মাকে আপাতত খুশি রাখার জন্যে এই চেষ্টা মানুষ করে যায়।
আমরা একবারটি দেখে নেবো কতটা যন্ত্রণায়; নস্টালজিয়ায়; মায়ের প্রতি আত্মার কাঁপুনিতে দিন পার করছেন তসলিমা।
সুদীর্ঘ ৩০ বছর আগে কেনা বাংলাদেশের একটি শাড়ি সযত্নে তাঁর কাছে এখনো লালিত। ভাজেভাজে ছিঁড়ে গেছে সেটি। তবুও তো মা-মায়ের বাড়ির সেই শাড়ি! ধুলোবালি মাখা হোক না, হোক না রং ওঠা, নেতিয়ে যাওয়া! তবুও সে শাড়িতে রয়েছে বাংলার আবেগ; সেই অন্তহীন ভালোবাসা; সেই ময়মনসিংহ!
সেই ময়মনসিংহ, শহিদ মিনার, ভাষা শহিদদের সহস্র মাইল দূর থেকে শাড়ির গন্ধে আর বাংলা ভাষার প্রতি থাকা মমত্ববোধের মাধ্যমে উপলব্ধি করলেন তসলিমা।
বাঙালি বন্ধুদের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া সেরেছেন। কারণ ২১তো বাংলাদেশের দিন!
এদিন লেখক নাসরিনের অতিথিদের মধ্যে ছিলেন বৌদ্ধ, মুসলমান, হিন্দু, নাস্তিক। সবাই বাংগালি। নেই ভেদাভেদ, নেই আস্তিক-নাস্তিকের মাঝে কোন বিরাট প্রাচীর। আছে শুধু বন্ধুত্ব।
“এরাই তো আমরা। এদের মধ্যেই বন্ধুত্ব দরকার।”
২১শে ফেব্রুয়ারি তাঁর অতিথিদের মধ্যে ছিলেন রাহুল বড়ুয়া, রামিজা খাতুন, সুদীপ্তা ঘোষ।
প্রবাসের বিলাসবহুল জীবন আমাদের ডলার দিয়েছে কেড়ে নিয়েছে বাকি সব মধুর স্মৃতি। কিন্তু প্রকৃত দেশপ্রেমীর মন শত ডলারও কাড়তে পারে না। পারেনি তসলিমাকে। তাই যুগে যুগে মৌলবাদী নির্যাতনে ভুক্তভোগি তসলিমা ছেঁড়া, নেতিয়ে যাওয়া দেশের কাপড়টি পরেই অমর ২১শে ফেব্রুয়ারি পালন করলেন।
পৃথিবীতে এমন অনেকে দেশান্তরী হয়ে আবার আপন জন্মভূমির টানে প্রত্যাবর্তন করেছেন। কিন্তু যারা কখনো নিজের দেশে ফিরতে পারেন নি কিংবা যেতে পারেন নি, তাঁদের অন্তরে যে কষ্টবোধ ও বেদনার কান্না বয়ে যায়, তা ভুক্তভোগি ছাড়া অন্য কারো পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।
লেখক ফেসবুকে শেয়ার করেছেন মর্মান্তিক, হৃদয় নিংড়ে রক্ত বের করে ফেলা একটি কবিতা!
“আজ ভাষা দিবস।
ঘরে আমি আর আমার বেড়াল,
আর কেউ নেই। কোথাও যাবার নেই সারাদিন।
না আমার, না বেড়ালের।
আজ তোমরা গান গাও, আজ নাচো।
ভাষার উৎসব করো, স্বরবর্ণে সাজাও শহর,
ব্যাঞ্জনবর্ণে শরীর।
কবিতা পড়তে পড়তে চোখের জল ফেলো। গান গাইতে গাইতে
শহিদ মিনারের দিকে হাঁটো। যত ফুল আছে দেশে,
মিনারের পাদদেশে দাও। ভাষাকে ধন্য করো।
আজ তোমাদের দিন।
তোমরা এক একজন সৈনিক ভাষার কসম খেয়ে
বড় বড় প্রস্তুতি নাও আগামির, নিতে হয়, এই দিনে এমনই নিয়ম।
এ দিন আমার নয়। ছিল কোনও একদিন আমার দিন।
আমার ভাষা থেকে আমাকে তাড়িয়েছ আজ পঁচিশ বছর,
ভাষার ত্রিসীমানা থেকে আমাকে বিদেয় করেছ দেড়যুগ হল।
অন্য ভাষাকে অনুচ্চারিত রেখে, অন্য দেশকে অস্বীকার করে,
তোমাদের বন্ধ দরজার সামনে অপেক্ষা করছি অনেক বছর,
দরজা কিন্তু কেউ খুলছো না।
আমি যে দাঁড়িয়ে আছি, দেখছ, কিন্তু কোথাও বলছো না দেখছো
যেন দেশটা তোমাদের একার,
যেন তোমাদের একার ভাষা, যে ভাষায় আমি কথা বলি।
যে ভাষায় লিখি, তা আমার নয়, তোমাদের, তোমাদের একার।
যে ভাষায় আমার শৈশব কৈশোর, যে ভাষায় যৌবন,
যে ভাষায় স্বপ্ন দেখি, আমার নয়, কখনও ছিল না, তোমাদের সব।
ভাষাকে যেন আমি যত বাসি, তার চেয়ে বেশি ভালোবাসো
বা বেসেছিলে কোনওদিন!
আজ ভাষা দিবস,
আমিও ভাষার উৎসব করবো আজ।
তোমাদের ওই ভাষায় একটি শব্দও আমি উচ্চারণ করবো না আজ,
একটি শব্দ কোথাও লিখবো না আজ,
আজ উৎসব করবো কোনও স্বপ্ন না দেখে,
আজ শুধু বেড়ালের সঙ্গে কথা বলবো, বেড়ালের ভাষায়।”
দেশকে একদিন অবশ্যই স্বীকার করতে হবে ‘অবোধ আমি অবহেলা করি’ অথবা
“বহু দিন ধ’রে বহু ক্রোশ দূরে. বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে. দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,. দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু। দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া. ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া. একটি ধানের শিষের উপরে. একটি শিশিরবিন্দু।”