আওয়ামী লীগ ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে দ্বিতীয় দফা সংলাপ বুধবার। সকাল ১১ টায় গণভবনে এই সংলাপে দুই পক্ষের শীর্ষ নেতারা ছাড়াও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা থাকবেন। ক্ষমতাসীন জোটের সাথে বিরোধীদলীয় জোটের বুধবারের সংলাপে কী সমাধান আসবে, না-কি বিরোধপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও তীব্র হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে দারুন সংশয় রয়েছে।
গত ১ নভেম্বর প্রথম দফা সংলাপ শেষে কোন সমাধান না আসায় হতাশা প্রকাশ করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ফ্রন্টের ৭ দফা দাবির কোনটাই সুনির্দিষ্টভাবে মানা হয়নি বলে জানান নেতারা। অপরদিকে আওয়ামী লীগ সংবিধানের বাইরে গিয়ে কোন দাবি মানবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয়। এমন প্রেক্ষাপটে আজকের সংলাপে নির্বাচনকালীন সরকার ও সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার বিষয়ে সংবিধানের মধ্যে থেকেই প্রস্তাব দেবে ঐক্যফ্রন্ট। ফ্রন্টের নেতারা বলেছেন, সংবিধানেই সংসদ ভেঙ্গে নির্বাচন দেয়ার বিধান রয়েছেন। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা সম্ভভ। এক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন।
অনেকের আশঙ্কা, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকলে হয়তো বুধবার সংলাপের ইতি টানতে হবে। সমঝোতা পৌঁছানোর চেষ্টাও শেষ হবে। নির্বাচনকালীন সরকারসহ বড় ইস্যুতে দুই জোটের মধ্যকার বিদ্যমান বৈরিতা দূর না হলে দেশ সংঘাতের দিকে যাবে এটাও স্পষ্ট হচ্ছে। কারণ, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা মঙ্গলবারের সমাবেশ থেকে কয়েকটি কর্মসূচি ঘোষণা করে সমঝোতনা না হলে কঠিন আন্দোলনের ইঙ্গিত দিয়েছেন।
জানা গেছে, বুধবার সংলাপে মূলত সংসদ ভেঙে দিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি-পাল্টা যুক্তি আসবে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। ঐক্যফ্রন্ট গত তিনদিন ধরে আইনজ্ঞদের নিয়ে বৈঠক করে সংবিধানের ভেতরে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সম্ভব বলে মনে করছেন।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের একাধিক নেতা বলছেন, তফসিল ঘোষণা পিছিয়ে দিয়ে সংলাপ অব্যাহত রেখে একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে চান তারা। সে পথ তারা বন্ধ করতে চান না। এ জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে থেকে বড় কর্মসূচি ঘোষণা করেননি। প্রয়োজনে আরও সংলাপে আগ্রহী। অবশ্য, সরকারি দলের নেতারা বলছেন, তারা এখনো আগের অবস্থানেই আছেন। সংবিধানের বাইরে অর্থ্যাৎ আওয়ামী লীগের অধীনেই আগামী নির্বাচন হতে হবে।
ঐক্যফ্রন্টের নেতারা নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলে নির্বাচনকালীন সময়ে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করা ছাড়াও নির্বাচনের পরিবেশ সংক্রান্ত বেশ কিছু দাবি মানার বিষয়ে ইতিবাচক আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারকরা।
সরকারি দলের নেতারা বলছেন, ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শীর্ষ দাবি, নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া। কিন্তু এটা এখন আর রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ ছাড়া সম্ভব না। কারণ, নির্বাচন পূর্ববর্তী জাতীয় সংসদের ৯০ দিনের কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে ৩১ অক্টোবর থেকে। এখন আর সংসদ ভেঙে দেওয়ার বিষয়টি সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে নেই। সবমিলিয়ে সংসদ না ভাঙার বিষয়েই সরকারি দলের নেতাদের মনোভাব।
ঐক্যফ্রন্টের অপর গুরুত্বপূর্ণ দাবি, নির্বাচনকালীন সময়ে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ করে নিরপেক্ষ কাউকে সরকারপ্রধান করা। এই দাবির বিষয়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের অভিমত, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর পর উচ্চ আদালতের রায়ের কারণে এই সুযোগ আর নেই। এখন স্পষ্ট বলা আছে, অনির্বাচিত কেউ সরকারপ্রধান হতে পারবেন না। তাই ঐক্যফ্রন্টের দাবি মানতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। সরকারি দলের নেতারা মনে করেন, বিরোধী পক্ষ এতোটা শক্তিশালী না যে তাদের আন্দোলনের ভয়ে সংবিধান সংশোধন করার প্রয়োজন দেখা দিবে।
বিরোধী জোটের দাবি, আগামী জাতীয় নির্বাচন এবং নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সৃষ্ট সঙ্কটের সমাধান সংবিধানের ১২৩ (৩) খ উপ দফায় এবং ৫৬ (২) অনুচ্ছেদে আছে।
ঐক্যফ্রন্টের প্রধান শরিক বিএনপির আইনজ্ঞ নেতারা ইতোমধ্যে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে রূপরেখা তৈরি করেছেন। সেই রূপরেখা মতে, ১২৩ (৩) অনুচ্ছেদের (খ) উপ-দফায় সংসদ ভেঙ্গে নির্বাচনের বিধান রয়েছে। এতে উল্লেখ রয়েছে, ‘মেয়াদ-অবসান ব্যতীত অন্য কোন কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পরবর্তী নববই দিনের মধ্যে।’৫৬ (২) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপ-মন্ত্রীদিগকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দান করিবেন’।
ঐক্যফ্রন্টের আরেক শীর্ষ দাবি, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারামুক্তি। এ বিষয় সরকারের শীর্ষ নেতারা বলছেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি আদালতের এখতিয়ার এখানে সরকারের কিছু করার নেই। দুইটি উপায়ে তিনি কারামুক্তি পেতে পারেন, একটি হলো প্যারোলে বের হওয়া অপরটি দোষ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়া। রাজনৈতিক কারণে দ্বিতীয়টি করবেন না খালেদা জিয়া সেক্ষেত্রে তিনি প্যারোল চাইলে সরকার আন্তরিকতার সাথে বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে। তবে এটিও সম্পূর্ণ আদালতের এখতিয়ার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারি দলের দুজন শীর্ষ নেতা আলাপকালে বলেন, খালেদা জিয়ার প্যারোল নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের নেতারা আলাপ করলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও সুকিচিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে বিদেশ পাঠানোর দাবি উঠতে পারে। পুরো বিষয়টি নির্ভর করবে আলোচনার টেবিলের পরিবেশের ওপর।
ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে দ্বিতীয় দফার সংলাপের আলোচনায় সরকারি দলও কিছু বিষয়ে ‘ছাড়’ দেয়ার মানসিকতা নিয়ে রেখেছে। নির্বাচনের আগে ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের নামে রাজনৈতিক মামলা না দেওয়া, সভা-সমাবেশের নিশ্চয়তা দেওয়া, নির্বাচনের সময় মন্ত্রী-এমপিদের সুযোগ সুবিধা কাটছাট করা, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে ঐক্যফ্রন্টের পরামর্শ আমলে নেওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনাসাপেক্ষে ছাড় দিতে পারে সরকারি জোট।
জানা গেছে, বুধবার সংলাপে ১৪ দলীয় জোট ও ঐক্যফ্রন্ট-দুই পক্ষের প্রতিনিধি দলই সংক্ষিপ্ত আকারে বসবে। সরকারি জোটের প্রতিনিধি দলে থাকবেন ১১ জন। নেতৃত্ব দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক্যফ্রন্টের নেতৃত্ব দেবেন ড. কামাল হোসেন।