ময়মনসিংহ লাইভ ডেস্ক : স্বাধীন বাংলাদেশের যে অভ্যুদয়, তার মূলে জড়িয়েছে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। মাতৃভাষায় কথা বলার এই আন্দোলনের সফলতার সূত্র ধরেই বাঙালি পেয়েছে পরাধীন মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার শক্তি ও সাহস। নির্মাণ করতে পেরেছে নিজস্ব রাষ্ট্রযন্ত্র। আর এই আন্দোলনে বাংলাকে রাষ্টীয় ভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যারা সক্রিয় থেকে আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ছালেহা বেগম ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ।
ছালেহা বেগমকে সবাই আদর করে ডাকতেন ছালু আপা। জন্ম ১৯৩৫ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। ১৯৫২ সালের আন্দোলনের সময় তিনি ছিলেন ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস হাই স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। বাবা এ এম আশরাফ আলী, মা মনিরুন্নেসা খাতুন। বাড়ি সিলেট অঞ্চলের মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া থানার উছলাপাড়া গ্রামে। মোটা দাগে এই হলো ছালেহা বেগমের পরিচয়।
ছালেহা বেগমের বড় বোন আরেক বিখ্যাত ভাষা সৈনিক রওশন আরা বাচ্চু। মাতৃভাষা আন্দোলনে অগ্রগামী সদস্য বাচ্চুকে অনুসরণ করেই বায়ান্নর মিছিলে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন ছালেহা। এরপর পুলিশের মার, দাঙ্গা-হাঙ্গামা কিংবা জেল-জরিমানার কোনো ঘটনাই তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।
বড় বোন রওশন আরা বাচ্চু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনে অনার্স পড়ার সুবাদে ছাত্র রাজনীতি ও মাতৃভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯৪৮ সালে বাবা আশরাফ আলী সাব-রেজিস্ট্রার হিসেবে কর্মরত ছিলেন পিরোজপুরে। ওই সময় মেজো বোন হোসনে আরা বেগম ছিলেন পিরোজপুর আরবান গার্লস স্কুলে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে ১১ মার্চ স্কুল থেকে ধর্মঘটের ঘোষণা করেছিলেন হোসনে আরা।
বায়ন্নতে ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস হাই স্কুলে দশম শ্রেণিতে ছিলেন ছালেহা বেগম। থাকতেন স্কুলের হোস্টেলে। ২১ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে করা মিছিলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে শহিদ হন অনেকে। সর্বত্র শুরু হয় বিক্ষোভ। সেই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে ময়মনসিংহেও। ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস হাই স্কুলের শিক্ষার্থীরা সেদিন ক্লাসে যোগ দেয়নি। তারা বিদ্যালয়ে উঠিয়ে দেয় কালো পতাকা। শহরজুড়ে শুরু হয় মিছিল। সেই মিছিলের মূল কারিগর ছিলেন এই ছালেহা বেগম।
ওই সময়ে বাংলায় এক জেলা শহরে ভাষার দাবিতে মিছিল এবং সে মিছিলের নেতৃত্বে ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরী— সেদিনের তো বটেই, আজকের দিনের বাস্তবতাতেও এ ঘটনাকে অভূতপূর্ব বললে অত্যুক্তি হয় না। সে মিছিলের কথা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে শহর থেকে গ্রামে, সারাবাংলায়। ছালেহা বেগমের মতো অনেক কিশোর-কিশোরী শ্রেণিকক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে, ভাষার দাবিতে স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত হয় গ্রাম-শহর।
ময়মনসিংহ শহরের ছাত্র-জনতা সেদিন সকাল থেকেই ঢাকায় কী হচ্ছে, সে খবর জানতে অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় করছিলেন। দুপুরে জেলা টেলিফোন অফিসের মাধ্যমে খবর আসে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়েছে পুলিশ। পরে রাতে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা মেইল ট্রেনের যাত্রীদের কাছ থেকে জানা যায়, বরকত-রফিক-জব্বার-সালাম আর ৯ বছরের ছোট্ট শিশু ওহিউল্লা গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হয়েছেন।
পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার সকালে ময়মনসিংহের সব স্তরের মানুষ তখনকার রাজনীতিবিদ রফিক উদ্দিন ভূঁইয়ার বাড়িতে একত্রিত হন। ভাষার আন্দোলনে পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে ময়মনসিংহ শহরে বিক্ষোভ ও কালো পতাকা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত নেন। আন্দোলনে মেয়েদের উপস্থিত করার পক্ষে মত দেন সৈয়দ সুলতান আহমেদ, আফতাব উদ্দিন ও শামসুল হকসহ অন্যরা।
সেদিন বিদ্যাময়ী স্কুল ও মুসলিম গার্লস হাই স্কুলের ছাত্রীদের আন্দোলনে যুক্ত করে মূল আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন ছালেহা বেগম। কালো পতাকা হাতে বজ্র কণ্ঠে আওয়াজ তোলেন— ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই, বাংলা চাই’, ‘রাজপথে গুলি কেন, জবাব চাই, জবাব চাই’।
পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারিও মিছিল হয় কালো পতাকা হাতে। সেদিন ছালেহা বেগমের সঙ্গে অন্য মেয়েদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন শহিদ জননী জাহানারা ইমামের ছোট বোন তাহমিদা সাইদা। তিনিও বিদ্যাময়ী স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলেন। আরও ছিলেন সুফিয়া খানম।
ওই সময় ময়মনসিংহে অন্য যারা ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সৈয়দ বদরুদ্দিন হোসাইন, মতলুব আনাম হিরা ভাই, মাহবুব আনাম ওরফে গোড়া ভাই, রজব আলী ফকির, মোজাম্মেল হক, শামসুল হক, মীর আবুল হোসেনসহ আরও অনেকে। তারা বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন সংগ্রাম পরিষদের নেতা হিসাবে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন।
তবে ছালেহা বেগমের আন্দোলনে নামার পথও সহজ ছিল না। বায়ন্নর ওই ২১ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনরত কর্মসূচিতে পুলিশের গুলিবর্ষণের খবর ছড়িয়ে পড়লে সারাদেশ অচল হয়ে পড়ে। সরকারি অফিস-আদালত বন্ধ হয়ে যায়, রেডিওতে শিল্পীরা বর্জন করেন অনুষ্ঠান। যার প্রভাবে ময়মনসিংহ শহরও থমথমে হয়ে ওঠে। ছালেহা বেগম যে হোস্টেলে থাকতেন, সেখানে বাড়ানো হয় নিরাপত্তা। ছাত্রীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে হোস্টেল সুপার ‘সুফি আপা’ সেদিন আরও একটু বেশি কড়া হয়ে ওঠেন। কিন্তু সেদিন ছালেহাকে আটকাবে এমন সাধ্য কার?
বান্ধবী বেলী, আছমা খাতুন ও টেইলার মাস্টার হোসেন ভাইয়ের সহায়তায় সেদিন ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস হাইস্কুলে শোকের কালো পতাকা ওড়ান ছালেহা। শিক্ষকদের চোখে এ ঘটনা ছিল রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধ। তার বাবা সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন বলে শিক্ষকরা সেদিন তাকে মারধর করেননি। তবে বিচারের নামে কথার ধারালো তীরে বিদ্ধ করা হয় তাকে। স্কুলের অধ্যক্ষ, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসক এম এ মুজিব মিলে ছালেহা বেগমকে স্কুলের নিয়মশৃঙ্খলা ভঙ্গের অযুহাতে তিন বছরের জন্য বহিষ্কার করেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি ছালেহাকে স্কুল ছাড়তে বাধ্য করা হয়। তিন বছর পর ছোটদের সঙ্গে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার মতো মন-মানসিকতা ও পরিবেশ তখন ছিল না বলেই আর কখনো স্কুলে ভর্তি হননি ছালেহা। তার প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। অল্প বয়সেই বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে।
পরবর্তী জীবনে ছালেহা বেগম একেবারেই নিভৃতচারী হয়ে পড়েন। এমনকি নিজের এই গৌরবোজ্জ্বল অবদানের কথাও পরিবারের সদস্যদের বাইরে প্রকাশ করতেন না কোথাও। স্কুলের সেই বহিষ্কারাদেশের কথা মনে পড়লেই বুক ভাসিয়ে কান্না করতেন এই সাহসিকা।
খুব বেশি লেখাপড়া না করলেও কয়েক বছর তিনি শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখার অভিজ্ঞতা নিয়েই ১৯৫৮ সালে তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন। এর আগে দুই বোন রওশন আরা বাচ্চু ও হোসনে আরা বেগমকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন কুলাউড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তাকে সার্বিক সহযোগিতা করেন স্থানীয় শিক্ষক বিধু বাবু। ১১ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করা এই বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষয়ত্রী ছিলেন ভাষা সৈনিক রওশন আরা বাচ্চু। স্কুলটি বর্তমানে কুলাউড়া বহুমুখী গার্লস হাই স্কুল নামে পরিচিত। বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা পাঁচ হাজারেরও বেশি।
নিজে উচ্চ শিক্ষা নিতে না পারলেও ছালেহা বেগম শিক্ষকতা পেশাটিকে খুব ভালোবাসতেন। নিজের ছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করতেন পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার জন্য। শেষ বয়সে নিজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে স্মৃতিচারণ করতেন তিনি। সেসব স্মৃতিতে ঘুরে ফিরে আসত ভাষা আন্দোলন আর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন স্বপ্নের কথা।
কেবল ভাষা আন্দোলন নয়, বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রাম তথা মহান মুক্তিযুদ্ধেও ছালেহা বেগমের অবদান ছিল উল্লেখ করার মতো। ১৯৭১ সালে নিজের বানানো কুলাউড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প করে থাকতে দেন ছালেহা। ভাই আমির আলীকে দিয়ে নিজে রান্না করে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খাবারও পাঠাতেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের ৯ মাস তিনি এভাবেই মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করে গেছেন।
আজন্ম দেশ ও দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাওয়া ছালেহা বেগম ২০০৪ সালের ১৯ আগস্ট সিলেটের কুলাউড়ায় নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। স্বামীর ইচ্ছায় পরদিন কিশোরগঞ্জ হয়বৎ নগর জমিদার বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। তার স্বামী ছিলেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র সাংবাদিক সংগ্রাহক ও কলামিস্ট সৈয়দ আব্দুল আহাদ মশকূর। তিনি হয়রত শাহ জালাল (রা.)-এর সহচর হযরত হামজা (রা.)-এর উত্তরপুরুষ।