কেমন ছিল ১৯৫২ সালের ময়মনসিংহ?’ ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে কেন্দ্রীয়ভাবে সমগ্র পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘট, সভা-সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে ময়মনসিংহের রাজনৈতিক নেতারাও সে অনুযায়ী কর্মসূচি নেন। ময়মনসিংহের ছাত্র-জনতা সেদিন সকাল থেকেই ঢাকার খবরাখবরের অপেক্ষায় থাকে। একুশে ফেব্রুয়ারি দুপুরে জেলা টেলিফোন অফিসের ফোনের মাধ্যমে এবং রাতে ঢাকা থেকে আসা মেইল ট্রেনের যাত্রীদের কাছে ময়মনসিংহের জনগণ জানতে পারে ঢাকায় হত্যাকাণ্ডের কথা। এসব কথা জানার পরিপ্রেক্ষিতে উত্তেজিত হয়ে ওঠে জনতা। সর্বস্তরের মানুষ দলে দলে সমবেত হতে থাকে আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা রফিক উদ্দিন ভূঁইয়ার শ্যামাচরণ রায় রোডের বাড়িতে। রফিক উদ্দিন ভূঁইয়ার এ বাড়িটি তখন ছিল ময়মনসিংহে সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র।
সে যা-ই হোক, একুশে ফেব্রুয়ারি অনেক রাত পর্যন্ত আলাপ-আলোচনা করেও যথাযথ কর্মপন্থা নির্ধারণে সক্ষম হলেন না স্থানীয় নেতারা।
পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ঢাকায় পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে স্থানীয় টাউন হল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত এক সভায় রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া আকস্মিকভাবে কিছু প্রস্তাব উত্থাপন করলে সঙ্গে সঙ্গেই সেগুলো লাভ করে সর্বসাধারণের সর্মথন। উত্তেজিত জনতার মুহুর্মুহু স্লোগানে মুখর সেই সভায় বক্তব্য দেন সৈয়দ সুলতান আহমদ, আলতাফ উদ্দীন তালুকদার, রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া, জেলা ছাত্রলীগের সম্পাদক শামসুল হকসহ আরও অনেকে। সেদিন সেই সভাস্থলেই গঠন করা হয় ময়মনসিংহ জেলা সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সংগ্রাম পরিষদ। ২৫৬ সদস্যবিশিষ্ট সেই পরিষদের সভাপতি মনোনীত হন আনন্দমোহন কলেজের তত্কালীন শিক্ষক সৈয়দ বদরুদ্দিন হোসাইন এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া।
নবগঠিত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সংগ্রাম পরিষদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৩ ফেব্রুয়ারি বৃহত্তর ময়মনসিংহে পালিত হয় সাধারণ ধর্মঘট। বন্ধ থাকে সব অফিস-আদালত, কলকারখানা, দোকানপাটসহ সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। সকাল থেকেই আনন্দমোহন কলেজের ছাত্ররা সংগ্রামমুখর জনতার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শুরু করে মিছিল। তাহমীদা সাইদার নেতৃত্বে মেয়েদের একটি দল কলেজ থেকে বেরিয়ে বিদ্যাময়ী স্কুলের সামনে জড়ো হয়। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা হাসিনা খানম মূল ফটকে তালা ঝুলিয়ে কঠিন প্রহরার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু এত প্রহরা সত্ত্বেও শেষ রক্ষা হলো না বিদ্যাময়ী স্কুল কর্তৃপক্ষের। মুষ্টিবদ্ধ হাত শূন্যে উত্তোলন করে, কণ্ঠস্বর জোরালো করে আন্দোলনরত মেয়েরা যখন তুলল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান, সঙ্গে সঙ্গেই বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো বেরিয়ে এল স্কুলের ছাত্রীরা। তারপর? নারী-পুরুষের যৌথ পদচারণে ময়মনসিংহের রাজপথ প্রকম্পিত হলো; সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে জনসমাবেশ হলো বিপিন পার্কে, রেলওয়ে স্টেশন চত্বরে।
২৪ ফেব্রুয়ারি, রোববার। সেদিন সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় স্বাভাবিকভাবেই কর্মচাঞ্চল্য কম ছিল ময়মনসিংহে, কিন্তু বিক্ষোভ প্রদর্শন, মিছিল, সমাবেশ হয় যথারীতিই।
২৫ ফেব্রুয়ারি, সোমবার, সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ছাত্র-জনতা অবস্থান ধর্মঘট পালন করায় ময়মনসিংহের অফিস-আদালতে সৃষ্টি হয় অচলাবস্থা।
২৬ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার, ময়মনসিংহ শহরে পূর্ণ হরতাল পালিত হয় আবার—এভাবেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের তীব্রতা দিন দিনই বাড়ে ময়মনসিংহে, অন্যদিকে বাড়ে আন্দোলন সংগ্রাম দমনে শাসকগোষ্ঠীর অশুভ তত্পরতা। ময়মনসিংহে নেতৃস্থানীয় ২৩ জনের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা অ্যাক্টের অধীনে পাকিস্তান সরকার জারি করল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা।
২৭ ফেব্রুয়ারি সৈয়দ বদরুদ্দিন হোসাইন, শামসুল হক, মোজাম্মেল হক, হাতেম আলী তালুকদার, অ্যাডভোকেট হাশিম উদ্দিন, মীর কফিলউদ্দিন (লাল মিয়া), মতলুব আনাম (গোড়া মিয়া), মাহবুব আনাম (হীরা মিয়া), রজব আলী ফকির, মীর আমীর হোসেনসহ ময়মনসিংহ সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ২২ জন নেতাকে গ্রেপ্তার করল পুলিশ।
২৮ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার হলেন রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া। ছাত্রী মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়ার অপরাধে ১৫ দিনের জন্য নজরবন্দী হলেন তাহমীদা সাইদা। এমন করেই চলল দেশব্যাপী ভাষা আন্দোলনের আগুন নিভিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। কিন্তু সেই চেষ্টার ফলাফল কী হলো শেষ অবধি? আগুন কি নিভল? না; বরং বাড়ল—নক্ষত্র নিয়ন্ত্রিত নিয়তির মতো বেড়ে ওঠা সেই আগুনে পুড়ে ছারখার হলো পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সব অপচেষ্টা; শেষ অবধি জয়ী হলো বাঙালি, অপ্রতিরোধ্য গতিতে অর্জিত হলো রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি।