বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যেই একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে কৌশলী অবস্থান নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। বিরোধী দলকে মোকাবেলায় অনেক বিকল্প হাতে নিয়ে হঠাৎ করেই সরকার সংলাপের রাজনীতি সামনে এনে আন্দোলনের উত্তাপে পানি ঢেলে দিয়েছে। রাজনীতির চালকের আসনে এখন সরকার। দীর্ঘ দিন ধরে কোণঠাসা বিএনপি অসীম ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য যে প্রস্তুতি নিচ্ছিল সরকার সেটাকেও চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে। বাংলাদেশে অতীতে এমন কঠিন রাজনৈতিক পরিস্থিতি আর কখনো আসেনি।
সরকার ও বিরোধী দলের সূত্রগুলো বলছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া সরকারের সংলাপ সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। প্রথম দিনেই সরকারের সাথে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সংলাপে মতবিরোধ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ফ্রন্টের প্রধান ড. কামাল হোসেন স্পষ্টতই বলেছেন, আমরা কথা বলেছি। কিন্তু সেখানে সমস্যা সমাধানের কোনো ইঙ্গিত পাইনি। সরকারি দলের পক্ষ থেকে সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে জানানো হয়েছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাত দফা দাবির বিষয়ে ফের আলোচনায় বসার ইঙ্গিত ছাড়া আর কোনো আশার কথা সেখানে নেই। সাত দফার প্রধান দুই দফা বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে কোনো কথা বলতেই তারা রাজি হননি। অন্যান্য দাবির ব্যাপারেও সুস্পষ্ট কোনো ঘোষণা আসেনি।
বিএনপিকে সাথে নিয়ে গড়ে ওঠা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বাইরে জাতীয় পার্টি, বিকল্প ধারাসহ অন্যান্য যেসব দল ও জোট রয়েছে তাদের জোরালো কোনো দাবি নেই। এসব দল ও মোর্চা মূলত খ উপ-দফা অনুযায়ী সংসদ ভেঙে দিয়ে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেন। তিনি বলেন, সংবিধানের ৫৬(৪) অনুচ্ছেদে সংসদ ভেঙে যাওয়া এবং পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যবর্তীকালে মন্ত্রিসভা পুনর্গঠনের বিধান রয়েছে। তিনি এ প্রসঙ্গে ২০১৩ সালে বিরোধী দলকে নির্বাচনী মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদানের প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের কথাও উল্লেখ করেন। কিন্তু ড. কামাল হোসেনের এ প্রস্তাবের সাথে সরকার একমত পোষণ করেনি।
সূত্র বলছে, ১৯৯১ সালে একটি অবাধ নিরপেক্ষ সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে নির্বাচনী রাজনীতির একটি ধারাবাহিকতা শুরু হয়। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মতবিরোধ একগুঁয়েমিতে পরিণত হওয়ায় সে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যায়নি। উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে আগামী দিনের রাজনীতিতে কী হতে যাচ্ছে এ নিয়ে আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে সংলাপের বাতাবরণের মধ্যে ক্ষমতাসীনদের একতরফা নির্বাচনের প্রস্তুতি এবং বিএনপিকে আরো কোণঠাসা করে ফেলার পরিণতি কী সেটা নিয়েই নানান রকম বিশ্লেষণ চলছে। গত এক সপ্তাহে বেশ কয়েকটি বড় ঘটনায় আগামী নির্বাচনে এর প্রভাব কতটুকু সেটা নিয়েও আলাপ আলোচনা শুরু হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, একটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের প্রস্তুতি দুই ধরনের। তারা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের চেয়ে এবারের নির্বাচনকে আরো অংশগ্রহণমূলক করতে চায়। সে ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টি, বিকল্প ধারা ও ইসলামপন্থী কিছু দলকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আর সরকারি ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর বাইরে কিছু বামপন্থী দলকেও তারা সাথে রাখার পরিকল্পনা নিয়েছে। এর বাইরে বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি ও তার শরিক দলগুলোর কোনো খণ্ডিত অংশকে আনা যায় কিনা সেটা নিয়েও তাদের ভাবনা আছে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই বিএনপির মূল শক্তি অর্থাৎ বেগম খালেদা জিয়া ও জামায়াতে ইসলামীকে এই নির্বাচনে তারা শামিল করতে চায় না।
সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ মেজরিটি নিয়ে ক্ষমতায় ফেরা এবং আগের তুলনায় অনুগত একটি বড় বিরোধী দল তৈরি করা। এই লক্ষ্য থেকে তাদের পিছপা হওয়ার সম্ভাবনা কম। আপাতত সংলাপকে সামনে রেখে একটি কৌশলী ভূমিকা নিয়ে নির্বাচন দ্রুততম সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করার লক্ষ্য নিয়েই এগোচ্ছে তারা। এ লক্ষ্য অর্জনে প্রধান বাধা হিসেবে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। সরকারি দল মনে করছে বিএনপি নেতৃত্বের মূল অংশকে অকার্যকর করা গেলে কোনো প্রতিবন্ধকতাই আর থাকবে না। সে লক্ষ্যেই আকস্মিকভাবে সংলাপের আয়োজন করা হয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, ১৯৯১ সালে নতুন আঙ্গিকে সংসদীয় রাজনীতির যে যাত্রার সূচনা হয়, ১৯৯৪ সালে মাগুরার একটি উপনির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে আওয়ামী লীগই প্রথম বিরোধী দলের আন্দোলনে নতুন মাত্রা যুক্ত করে। সে সময় কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান স্টিফেন দুই পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতার চেষ্টা করেন। কিন্তু সে দূতিয়ালি ব্যর্থ হয়। তখন আওয়ামী লীগের সাথে জামায়াতে ইসলামীও আন্দোলনে শরিক হয়ে সংবিধানে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করতে বিএনপিকে বাধ্য করে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং এর কিছু দিন পরই সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন হয়। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। বৃহত্তর বিরোধী দলে বসে বিএনপি। ২০০১ সাল পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারাবাহিকতা ঠিক থাকে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে আবারো বিএনপি ক্ষমতায় আসে। ২০০৫ সাল থেকে আবারো রাজনৈতিক অচলাবস্থা শুরু হয় এবং বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে নিযুক্তির ব্যবস্থা নিয়ে আওয়ামী লীগ আন্দোলনের সূচনা করে।
২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল সংলাপে বসেন। সে সংলাপও সাফল্য লাভে ব্যর্থ হয়। একপর্যায়ে ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দীন সরকার ক্ষমতায় আসে। এরপর অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়ে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করে দেয়। এতে আবার আন্দোলনের সূচনা হয়। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে জাতিসঙ্ঘের রাজনীতিবিষয়ক মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো বাংলাদেশে আসেন এবং দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার প্রচেষ্টা চালান। তার দীর্ঘ এ প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়। তিনি ফিরে যাওয়ার পর ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচন করে এবং ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন দলটির প্রার্থীরা। সে সময় দেশজুড়ে সহিংস আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে এবং একপর্যায়ে আওয়ামী লীগ পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম হয়। সংলাপ রাজনীতির এই ব্যর্থতার পটভূমিতে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সমঝোতার সম্ভাবনা কতটুকু তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেছে।