বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি ‘সোনালি কাবিন’ খ্যাত কালজয়ী কবি আল মাহমুদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। সাহিত্যে নিজের অমরতা নিশ্চিত করে বসন্ত-ভালোবাসার আবেশ গায়ে মেখে তিনি গত বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিদায় নিয়েছেন এ পৃথিবী থেকে। তিনি আর কখনো আসবেন না লোকালয়ে, অমর একুশে বইমেলায়। আসবেন না সৌম্য দৃষ্টি নিয়ে।
এ দিকে আল মাহমুদের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও তার জন্মভিটা ব্রাহ্মহ্মণবাড়িয়ায় পৃথক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। আল মাহমুদ ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক কবি আবিদ আজম জানিয়েছেন, কিংবদন্তি এ কবির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে রাজধানীর কাঁটাবনের কবিতা ক্যাফেতে (২৩৪/সি নিউ এলিফ্যান্ট রোড, কাঁটাবন সিগন্যাল, ঢাকা) আজ শনিবার বিকেল ৫টায় ‘আল মাহমুদ স্মরণ’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এতে কবির পাঠক, ভক্ত ও অনুরাগীরা উপস্থিত থাকবেন।
আর একই দিন চট্টগ্রামের থিয়েটার ইনস্টিটিউটে ক্বণন শুদ্ধতম আবৃত্তি অঙ্গনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হবে এক স্মরণানুষ্ঠান। সেখানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর নূরুল আমিনসহ অন্যরা।
অন্য দিকে কবির জন্মভিটা ব্রাহ্মহ্মণবাড়িয়া মৌড়াইলে সকালের দিকে স্মরণানুষ্ঠান ছাড়াও কবির কবরে শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন ও ফাতেহা পাঠ করা হবে। এ ছাড়া আল মাহমুদ স্মারকগ্রন্থ প্রকাশনা ছাড়াও কবির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বৃহৎ পরিসরে একটি অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছেন আবিদ আজম। এ দিকে ভাষা সংগ্রামী ও মুক্তিযোদ্ধা এ কবিকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদানে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানিয়েছেন কবি পরিবার।
১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৌড়াইল গ্রামের মোল্লাবাড়িতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আশীর্বাদ হয়ে জন্মগ্রহণ করেন বরেণ্য কবি আল মাহমুদ। পঞ্চাশের দশকে আবির্ভূত সাহিত্যের সব্যসাচী কবি আল মাহমুদ কবিতা ছাড়াও লিখেছেন উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, ছড়া, আত্মজীবনী ইত্যাদি। এ যাবৎ তার প্রকাশিত শতাধিক গ্রন্থ নিয়ে প্রকাশনা সংস্থা ঐতিহ্য মোট ১৩ খণ্ডে প্রকাশ করেছে ‘আল মাহমুদ রচনাবলি’।
১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় আল মাহমুদের প্রথম কবিতার বই ‘লোক লোকান্তর’। এর তিন বছর পর ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত হয় তার আরো দু’টি কবিতার বই ‘কালের কলস’ ও ‘সোনালি কাবিন’। এর মধ্যে ‘সোনালি কাবিন’ তাকে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়। এ ছাড়া তার ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’, ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’, ‘একচক্ষু হরিণ’, ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’ ও ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ কাব্যগ্রন্থ উল্লেখযোগ্য।
‘কাবিলের বোন’, ‘উপমহাদেশ’, ‘ডাহুকি’, ‘আগুনের মেয়ে’, ‘চতুরঙ্গ’ ও ‘পোড়ামাটির জোড়া হাঁস’ ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। ‘পানকৌড়ির রক্ত’সহ বেশ কিছু গল্পগ্রন্থও রচনা করেছেন তিনি। এ ছাড়া ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ ও ‘বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ’ তার উল্লেখযোগ্য আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের লিফলেটে কবিতা ছাপা হওয়ার কারণে ফেরারি হওয়া আল মাহমুদ একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামে মুজিবনগর সরকারের স্টাফ হিসেবে কাজ করেছেন, যুক্ত ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাথেও।
নিজের প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা রচনা করে গেছেন কালজয়ী দু’টি উপন্যাস ‘কাবিলের বোন’ ও ‘উপমহাদেশ’। তৎকালীন দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকার প্রাক্তন এই সম্পাদক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আন্তরিক সহায়তায় যোগদান করেছিলেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে।
সৃজনশীল সাহিত্য রচনার জন্য অসংখ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন আল মাহমুদ। বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৮), জয়বাংলা পুরস্কার (১৯৭২), হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৪), ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৬), একুশে পদক (১৯৮৭), নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৯০), সমান্তরাল (ভারত) কর্তৃক ভানুসিংহ সম্মাননা পদক-২০০৪ উল্লেখযোগ্য। নিজের অসামান্য সাহিত্যকীর্তির কারণে আল মাহমুদ জীবনব্যাপী মানুষের হৃদয়ে আর ইতিহাসের শিলালিপিতে যে অমরতা পেয়েছেন, কোনো স্বীকৃতিই তার সাথে তুল্য নয়।
মাহমুদ প্রাণহীন হলেও নিজ কীর্তির কারণে প্রাণে প্রাণে ছড়িয়ে আছেন। প্রভাতফেরি, আধ ফালি চাঁদ, নারী, নিসর্গ, ফুল-পাখি বা খড়ের গম্বুজের আড়ালে হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে তাকে। আর খুঁজলেই পাওয়া যাবে তার নতুন পাঁচটি বই।