ভাল নেই ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার কান্দানিয়া-বন্যাবাড়ির পাইট্যা পাড়ার অর্ধশত পরিবার। কারণ, আগের মত আর কদর নেই তাদের তৈরি শীতল পাটির।
প্লাস্টিক যুগের পণ্যের সাথে পেরে উঠছে না পাটি নির্মাতারা। বংশ পরম্পরায় এই পেশাকে আঁকড়ে ধরে পাটিয়ালদের সংসার চলছে অতি কষ্টে। তারপরও এখানের ৪৭/৪৮টি পরিবার বাপ-দাদার পেশাকে এখনো আঁকড়ে ধরে আছেন।
ধারালো দা দিয়ে বেত চিরে পাটির সরঞ্জাম প্রস্তুতে ব্যস্ত পাটিয়াল নিরঞ্জন চন্দ্র দাস বলেন, ‘আমার বাবা, দাদারও আগে থেকে আমরা বংশ পরম্পরায় শীতল পাটি তৈরির সাথে জড়িত। আমরা ছোট থেকেই অন্যকোন কাজ শিখিনি। কিন্তু এখন আর এ শিল্পের ভবিষ্যত ভাল দেখছি না।’
তিনি জানান, তার দুই সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে টাঙ্গাইলের একটি কলেজে অনার্সে পড়ছে। ছোট মেয়ে প্রাইমারিতে পড়ছে। সন্তানদের আর কষ্টের এ পেশায় রাখতে চান না তিনি।
পাটি তৈরিতে ব্যস্ত গৃহবধূ বিদ্যুৎ রানী দাস জানান, পুরুষরা পাটি বুননের সরঞ্জাম প্রক্রিয়াজাত করে দেন। আর নারীরা নানান ধরণের শীতল পাটি তৈরি করেন। এভাবে ৩/৪ দিনে ভাল মানের একটি শীতল পাটি তৈরি করা যায়। পরে সেটি মান ভেদে ৭শ থেকে দুই হাজার টাকায় বিক্রি হয়। এভাবেই কোন রকমে তাদের সংসার চলে।
তিনি জানান, আগে দূর দূরান্ত থেকে পাইকাররা এসে তাদের পাটি কিনে নিত। অনেক সময় পূর্ব থেকে পাটির জন্য অগ্রিম টাকায় অর্ডার দিয়ে যেতেন ক্রেতারা। কিন্তু আগের মত এখন আর পাটির কদর তেমনটি নেই।
এখানকার অধীর চন্দ্র দাস বলেন, ‘এক সময় এখানের সবাই শীতল পাটির সাথে যুক্ত ছিল। এখন এখানে ৪৭/৪৮টি পরিবার এ শিল্পকে আকঁড়ে ধরে পড়ে আছেন। এখানে সেদ্ধ শীতল পাটি, আওলা শীতল পাটি এবং ডালা পাটি তৈরি হয়। যার কদর এখনো আছে। স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকা এবং ঢাকা, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্নস্থানে তাদের তৈরি শীতল পাটি বিক্রি হয়।’
তবে, ‘আধুনিক প্লাস্টিক শিল্পের দাপটে তাদের পাটি শিল্প মার খাচ্ছে। সারা বছর এক রকম বিক্রি হয় না তাই পূঁজির টান পড়ে এ দরিদ্র শিল্পীদের। সেক্ষেত্রে দরকার সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণসহ সরকারি পিষ্ঠপোষকতার’ বলেন তিনি।
নিজে কাজ করার পাশাপাশি পাড়ার অন্যদের কাছ থেকে পাইকারি দরে পাটি কিনে বিভিন্ন হাটে বিক্রি করা গোপাল চন্দ্র দাস বলেন, ‘পাইকারি কিনে বাজারে বিক্রি করলে পাটি প্রতি ৫০/১০০ টাকা লাভ থাকে। এতে দরিদ্র স্বজাতিরও সাহায্য হয় আবার নিজের সংসারও চলে।’
পড়ালেখার পাশাপাশি বাবা-মাকে পাটি তৈরির কাজে সাহায্য করা কলেজ ছাত্র হৃদয় দাশ বলেন, ‘বাপ-দাদার এ পেশার প্রতি মায়া আছে। তাই সংসার চলার জন্য বাবা-মাকে সাহায্য করছেন। কিন্তু ভবিষ্যতে তিনি অন্য কোন পেশায় চলে যেতে চান।’
পাইট্যা পাড়ার মায়া রানী দাস (৫২) ও দুলাল দাস (৬০) দম্পতি জানান, এখন অনেক কষ্টে দিন চলে পাটিয়ালদের। এক প্রতিবন্ধি সন্তানসহ পাঁচ সদস্যের সংসার তাদের। পাটি তৈরির পাশাপাশি অন্যের জমিতে দিনমজুরি করতে হয়।
মায়া রানী অতীত স্মৃতিচারণ করেন। তিনি বলেন, ‘আগে যখন পাটির কদর ছিল, তখন কি জাঁকজমকপূর্ণ ছিল পাটিয়ালদের জীবন। তখন রাতের বেলায় প্রায়ই একেক বাড়িতে গানের আসর বসতো। নিয়মিত পূজা-অর্চনা চলতো বাড়িতে বাড়িতে। কিন্তু এখন এই পাইট্যা পাড়ায় কেবল অভাব আর অনটন। কেউ খুব ভাল নেই।’
পাটি শিল্পের বর্তমান দুরাবস্থার কথা স্বীকার করে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহীনুর মল্লিক জীবন বলেন, ‘আমরা তাদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করার চেষ্টা করবো।’
নির্দিষ্ট প্রকল্পের মাধ্যমে পাটির শিল্পকে টিকিয়ে রেখে এই পেশার মানুষগুলোকে স্বচ্ছলতার পথ তৈরি করে দিতে সরকারের প্রতি দাবি জানান তিনি।
ফুলবাড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশরাফুল ছিদ্দিক বলেন, ‘ফুলবাড়িয়ায় এই শিল্প সম্পর্কে আমার জানা নেই। তবে বিষয়টি শুনে আমার খুবই ভালো লেগেছে। আমি খুব শিগগিরই খোঁজ নিয়ে শিল্পের সাথে সম্পৃক্তদেরকে সরকারিভাবে কোন প্রকল্পের আওতায় আনার চেষ্টা করব।’ সূত্র-রাইজিং বিডি