সাংসারিক বা দাম্পত্য জীবনে পরকীয়া সবচেয়ে জটিল সম্পর্কের একটি। পরকীয়া নামের অসামাজিক বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের অশুভ থাবায় বিপর্যয়ের মূখে সংসার ও পরিবার প্রথা। অনেকেই সমাজ, লোকচক্ষু ও সন্তানের ভবিষ্যত চিন্তা করে নিরবে সহ্য করে যাচ্ছে স্বামী -স্ত্রীর এই নিষিদ্ধ প্রণয়লীলা। আবার অনেকেই পরকীয়ার নরক যন্ত্রণার অনল সহ্য করতে না পেরে ঘটাচ্ছেন বিবাহ বিচ্ছেদ। কেউবা আবার বেছে নিচ্ছে অত্মহননের মতো অভিশপ্ত পথ। এদিকে পরিসংখ্যানহীন পরকীয়া ঘটছে বাংলাদেশে।
সাধারণত বিবাহিত নর কিংবা নারীর পরপুরুষ বা পর নারীতে আসক্তি, শারীরিক সম্পর্ক পরকীয়া হিসেবে পরিচিত। পরকীয়ার ইংরেজি হলো Adultery, Extramarital affair, Extramarital sex .উইকিপিডিয়ার মতে পরকীয়া হলো বিবাহিত কোন ব্যক্তির (নারী বা পুরুষ) স্বামী বা স্ত্রী ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তির সাথে বিবাহোত্তর বা বিবাহবহির্ভূত প্রেম, যৌন সম্পর্ক ও যৌন কর্মকান্ড। Cambridge Dictionary তে বলা আছে, Sex between a married man or woman and someone he or she is not married to.এবার পরকীয়া নিয়ে দুটো কেস স্টাডি দেখি।
কেস স্টাডি -১
মিসেস জেসিকা একজন বিবাহিত নারী ও স্কুল শিক্ষকা। তাদের আট বছরের দাম্পত্য জীবনে এখনো তিনি নিঃসন্তান। স্বামী একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে জব করেন। জেসিকার প্রবল ইচ্ছে মা হবার। এজন্য যাবতীয় ডাক্তারী পরীক্ষা নিরীক্ষাও চালিয়েছেন। এখন তিনি অনেক নিরাশ এবং হতাশায় ভুগছেন।জেসিকা হতাশা দূর করতে বিভিন্ন ছেলেদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে সময় কাটান। কারো কারো সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। অথচ তার স্বামী সংসার রয়েছে।
কেস স্টাডি -২
জনাব দীপেন বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত। তিনি একজন অবিবাহিত পুরুষ। অনেক দিন পর তার বিবাহিতা একজন বান্ধবীর সঙ্গে ফোনো কথা হয়। বান্ধবীর নিঃসঙ্গতা মিষ্টি কণ্ঠ দীপেনকে আকৃষ্ট করে। এরপর দীপেন এবং বান্ধবী ফোনে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে, শারীরিক সম্পর্ক করে। এক সময় তার বান্ধবী স্বামী সংসার ছেড়ে চলে আসেএবং দীপেনকে বিয়ে করে কিন্তু এখন তাদের সংসারে সুখ নেই, প্রতিনিয়ত ঝগড়া। এমতাবস্থায় দীপেন ও তার স্ত্রী পর নারী ও পুরুষে আসক্ত হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মুসলমান। ইসলাম ধর্মের অনুসারী।ইসলাম ধর্মে পরকীয়া কঠিনভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে ।ইসলামি আইন শাস্ত্রে পরকীয়ায় জড়িত নারী পুরুষের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে, যা হলো পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যুদন্ডের শাস্তি। বাংলাদেশে সিনেমা, নাটক, উপন্যাস, গল্প ও শর্টফিল্মের বিভিন্ন দৃশ্যে পরকীয়ার চিত্র ও আলোচনা থাকলেও এনিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে তেমনটা দেখা যায় না।কেননা ধর্ম ও সামাজিক মূল্যবোধের সাথে বৈসাদৃশ্য পরকীয়া অবৈধ ও নিষিদ্ধ। পশ্চিমা বিশ্বে পরকীয়া নিয়ে গবেষণা ও জরিপ হলেও বাংলাদেশে তা দৃশ্যমান নয়।তার পরেও পরকীয়ার ঘটনা যে বাংলাদেশে ঘটছে না এমনটা কিন্তু নয়।এ বছরে বাংলাদেশে কয়েকটি পরকীয়া ঘটনার উল্লেখযোগ্য শিরোনাম হলো, পরকীয়া নিয়ে প্রতিদিন পত্রিকায় কোনো না কোনো সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে।স্ত্রীর পরকীয়ার বলি স্বামী-মেয়ে। (বাংলাদেশ প্রতিদিন ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৯)।মায়ের পরকীয়ার বলি শিশুসন্তান। (প্রথম আলো, ১৬ জুলাই ২০১৯) স্ত্রীর পরকীয়ার বলি চিকিৎসক। (একুশে সংবাদ, ৩১ জানুয়ারি ২০১৯)।
পরকীয়ার পেছনে বহুবিধ কারণ রয়েছে, অল্প বয়সে বিয়ে,শারীরিক সমস্যা, বিয়ের ক্ষেত্রে ভুল মানুষকে নির্বাচন করা, ক্যারিয়ার আডভান্সমেন্ট, পারিবারিক ও দাম্পত্য সম্পর্কের অবনতিতে পরকীয়া প্রভাব রাখে, বৈবাহিক জীবনে অসুখী, অবজ্ঞা, গৃহস্থলীর কাজে স্বামীর সহযোগিতা ইত্যাদি।
শুধু ঢাকা সিটি করপোরেশন যে পরিমাণ বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়েছে তা সামাজিক বন্ধনের বিচ্ছিন্নতাকে চরমভাবে নাড়া দিয়েছে। পরিসংখ্যান মতে,২০১৯ সালের বিগত ৬ মাসে অর্থাৎ ১৮০ দিনে ৪ হাজার ৫৫৭টি তালাকের আবেদন হলে একদিনে আবেদন হয়েছে ২৬টি তালাকের। অর্থাৎ প্রতি ৫৫ মিনিটে একটি সংসার ভাঙার আবেদন জমা পড়েছে নগর ভবনে।স্বামীর পরকীয়া, মাদকাসক্ত এসব গুরুতর কারণে যেমন তালাক হয়, আবার স্ত্রীর নানা দোষ দেখিয়েও স্বামীরা তালাকের আবেদন করে।
তবে পরকীয়া নিয়ে বিভিন্ন দেশে পরিসংখ্যান ও গবেষণা হলেও আমার জানা মতে বাংলাদেশের কোন সংগ্ঠন কিংবা সংস্থা পরকীয়া নিয়ে কোনো জরিপ ও গবেষণা চালায়নি। অথচ প্রতিনিয়ত পত্র পত্রিকা পরকীয়ার সম্পর্ক নিয়ে নানান দুর্ঘটনার সংবাদ ছাপা হচ্ছে ।বর্তমানে পরকীয়ার প্রবণতা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তথ্য প্রযুক্তির সহজলভ্যতা মোবাইল ফোন, ফেসবুকসহ নানা প্রযুক্তি মানুষের হাতের মুঠোয়, তাই আজকাল পরকীয়া সম্পর্ক গড়ে তোলা অনেক সহজ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।পরকীয়া যেন সেই বহমান নদীর মতো এ কূল ভাঙ্গে ঐ কূল গড়ে। একজনের সুখের সংসার ভেঙ্গে তছনছ করে আরেকটি চোরাবালিতে যেন পা দেওয়ার মতো। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরকীয়ার সম্পর্ক সুখের হয় না। এর পরিণতি হয় কখনো কখনো ভয়ঙ্কর ও অবমাননাকর, সামাজিকভাবে হতে হয় হেয় ও এক ঘরে।
মনোচিকিৎসায় একথা স্বীকৃত যে, পিতামাতার পরকীয়া সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর এবং সামাজিক সম্পর্ক ও যোগাযোগে বিরূপ প্রভাব ফেলে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা সন্তানের মানসিক বিষন্নতার ও আগ্রাসী মনোভাবের জন্ম দেয়| মিশরের একটি টিভির টক-শো অনুষ্ঠান ঐ টক-শো`র একজন অতিথি আলোচনার মাঝখানে হঠাৎ করেই মন্তব্য করে বসেন যে মিশরের অন্তত ৩০% মহিলা পরকীয়ার সাথে জড়িত।এরপরে মহা বিপদে পড়েন টেলিভিশনের কর্তাব্যক্তিরা।সারা দেশে এতটাই হৈচৈ শুরু হয় যে সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ অনুষ্ঠানটিকে ১৫ দিনের জন্য বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়। ধর্ম ও সামাজিক মূলবোধের কারণে পরকীয়ার মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে অনেকে মুখ খুলতে চায় না।
পরকীয়া নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে ভারতে। বিবাহবহির্ভূত ডেটিং অ্যাপ গ্লিডেনের জরিপ পরিচালনায় তা উঠে এসেছে । জরিপ বলছে দেশটিতে প্রত্যেক ১০ জন নারীর সাতজনই পরকীয়ায় লিপ্ত। নারীরা কেন ব্যভিচারে জড়িয়ে পড়ছেন’ শিরোনামে জরিপটি পরিচালনা করা হয়। ব্যাঙ্গালুরু, মুম্বাই, কলকাতার মতো শহরের নারীরা সবচেয়ে বেশি পরকীয়ায় লিপ্ত বলে জরিপে উঠে এসেছে।তবে জরিপে কিছু বিস্ময়কর তথ্য উঠে এসেছে জরিপকারী প্রতিষ্ঠান গ্লিডেনের একজন মার্কেটিং স্পেশালিস্ট জানিয়েছেন ‘জরিপে অংশ নেয়া প্রতি ১০ জন নারীর চারজন জানিয়েছেন, অপরিচিতদের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়ানোর পর স্বামীর সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে।
কয়েক বছর আগে পরিচালিত অ্যাপ ভিত্তিক এই জরিপ থেকে জানা যায়, ভারতের প্রায় ৪৮ শতাংশ নারী মনে করে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক থাকা উচিত। ২০ শতাংশ পুরুষ ও ১৩ শতাংশ নারী তাদের স্ত্রী এবং স্বামীকে ঠকিয়ে পরকীয়া করছেন বলে স্বীকার করেছেন। স্বামীকে ঠকিয়ে পরকীয়া করছে এমন ৭৭ শতাংশ ভারতীয় নারী বলেছেন, তাদের বিবাহিত জীবন একঘেয়ে হয়ে পড়েছে। তাই তারা বিয়ের বাইরে একজন সঙ্গীকে খুঁজে নিচ্ছেন। নিজের স্বামীর বাইরে একজন সঙ্গী খুঁজে পাওয়ার মধ্যে তারা ভিন্ন ধরনের উত্তেজনা অনুভব করেন।
ভারতে কোন বিবাহিত নারী বা পুরুষ যদি অন্য কারো সাথে পরকীয়া সম্পর্ক করেন – তাহলে তা আর ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য হবে না বলে সেদেশের সুপ্রিম কোর্টের রায় রয়েছে। একজন বিশ্লেষক ড. ক্যাথরিন মার্সার বলছেন, পুরুষদের তুলনায় নারীরা অবশ্য পরকীয়ার কথা স্বীকার করেন কম।যৌন আচরণের প্রশ্নে নারীদের প্রকাশ যে ভিন্ন সে কারণেই এমনটা হয় বলে তিনি ব্যাখ্যা করছেন।
বাংলাদেশে পরকীয়া সংক্রান্ত আইনের ৪৯৭ ধারায় বলা হয়েছে যে কোন বিবাহিত ব্যক্তি যদি অন্য কোন বিবাহিত নারীর সাথে জেনেশুনে যৌন সম্পর্ক করে তাহলে তা ব্যভিচার বলে গণ্য হবে। এ ক্ষেত্রে সেই পুরুষটির পাঁচ বছরের কারাদন্ড, অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডের বিধান আছে। তবে যে নারীর সাথে ব্যভিচার করা হয়েছে – তার ক্ষেত্রে আইনে কোন শাস্তির বিধান নেই, ব্যভিচারকারী নারী ও পুরুষ উভয়ের শাস্তির কথাও বলা নেই।তবে এই আইন সংশোধনের দাবি উঠেছে।তবে যাই বলি না কেন পরকীয়ার মতো অভিশপ্ত বিষয়টি নিয়ে আলোচনা, জনসচেতনতা সৃষ্টি ও এর কুফল নিয়ে প্রচারণার প্রয়োজন রয়েছে। পরকীয়ার মতো অসামাজিক ব্যাধিরও একটি জরিপ, পরিসংখ্যান থাকা প্রয়োজন। যাতে একে অঙ্কুরে নির্মূল করা সম্ভবপর হয়।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক মো. আবু রায়হান এর সৌজন্যে