মঙ্গলবার দিবাগত মধ্যরাতে ঘড়ির কাঁটা ১২টা অতিক্রমের সাথে সাথে শুরু হয়েছে নতুন বর্ষ গণনা। ঘটনাবহুল ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দ বিদায়ের পর শুরু হয়েছে নতুন বছর। স্বাগত ২০২০ সাল। আজকের সকালে যে সূর্য উঠেছে তা নতুন বছরের। নতুন বছরে নতুনভাবেই শুরু হলো পথচলা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এক অস্থির সময়কালে নতুন বছরের আগমন ঘটল। সময়ের স্রোতকে কখনোই ফ্রেমে আটকে রাখা যায় না। সময়কে বলা হয় কালস্রোত। মানুষ এই স্রোতে এগিয়ে চলে। কখনো এই এগিয়ে চলা হয়ে ওঠে বর্ণময়। কখনো বা বিবর্ণ ধূসর। কিন্তু যেভাবেই হোক না কেন সে থামতে পারে না। সময় তাকে থামতে দেয় না। এই কর্মময় জীবনে সময়ের স্রোত একমাত্র থামে জীবনের যবনিকাপাতের মধ্য দিয়ে। মানুষ যখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন যাত্রায় শামিল হয়েছে তখনই সময়ের প্রশ্ন উঠেছে। সময়ই জীবনকে এক কঠিন বাস্তবের মুখে নিয়ে যায়। সময় জীবনের সবচেয়ে বড় নিয়ামক। বড় পুঁজি। বড় শক্তি। প্রতিটি সেকেন্ড প্রতিটি মুহূর্ত জানান দেয় যে নির্ধারিত সময়কাল বুঝি শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমরা অতীত বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ হিসাব করি। কিন্তু এর কোনো স্থিতি নেই। এই মুহূর্তে যেটা বর্তমান কিছুক্ষণ পরই তা ধূসর বিবর্ণ অতীত। আবার ভবিষ্যৎ যা তারও কোনো স্থায়িত্ব নেই। ক্ষণে ক্ষণে ভবিষ্যৎ ঠাঁই নিচ্ছে বর্তমানে। আবার মুহূর্তেই তা হারিয়ে যাচ্ছে অতীতের মাঝে। এ এক বিস্ময়কর বিষয়। মানুষ নিজেকে জ্ঞান-বিজ্ঞান কিংবা আবিষ্কারের যেখানেই নিয়ে গেছে সীমাবদ্ধতাও তাকে আটকে রেখেছে। এই সীমাবদ্ধতাকে কখনোই সে অতিক্রম করতে পারেনি।
উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য সূত্র থেকে জানা যায়, এখন আমরা যে খ্রিষ্টীয় নববর্ষ পালন করি এরও রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস। আরব দেশগুলোতে হিজরি নববর্ষ এবং মুসলিম জাহানেও তা পালনের রেওয়াজ রয়েছে। গ্লোবালাইজেশন বা বৈশ্বিক কারণে ইংরেজি নববর্ষ বিশ্বব্যাপী নতুন উদ্যমে পালিত হয়। এর পেছনে ব্যবসায়িক স্বার্থও রয়েছে। প্রকৃত অর্থে আমরা যে ইংরেজি সাল বা খ্রিষ্টাব্দ মেনে চলি তা হলো গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। এই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ইংরেজি নববর্ষ পালন করা হয়। এই ক্যালেন্ডার নিয়েও রয়েছে নানা বিতর্ক। এখনকার মতো শুরুতে সার্বজনীনভাবে ১ জানুয়ারি নববর্ষের প্রচলন ছিল না। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার প্রকৃতপক্ষে একটি সৌর বছর। ধাপে ধাপে মানুষ সৌর বছরের বর্তমান ধারায় উপনীত হয়েছে। প্রথম দিকে মানুষ চাঁদের হিসাবেই নতুন বর্ষ গণনা শুরু করেছিল। চাঁদের হিসাবে ১০ মাসে বছর হতো। সেখানে ঋতুর সাথে কোনো সম্পর্ক ছিল না। সূর্যের হিসাবে বা সৌর গণনার হিসাব আসে অনেক পরে। সৌর এবং চন্দ্র গণনায় আবার পার্থক্য রয়েছে। সৌর গণনায় ঋতুর সাথে সম্পর্ক থাকে।
প্রায় চার হাজার বছর আগে, খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে মেসোপটেমীয় (ইরাক) সভ্যতায় প্রথম বর্ষবরণ উৎসব চালু হয়েছিল। মেসোপটেমীয় সভ্যতার আবার চারটি আলাদা ভাগ আছে, সুমেরীয় সভ্যতা, ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, আসিরীয় সভ্যতা ও ক্যালডীয় সভ্যতা। এর মধ্যে বর্ষবরণ উৎসব পালন শুরু হয় ব্যাবিলনীয় সভ্যতায়।
সে সময় বেশ জাঁকজমকের সাথেই করা হতো এই বর্ষবরণ। তবে সেটা কিন্তু এখনকার মতো জানুয়ারির ১ তারিখে হতো না। তখন নববর্ষ পালন করা হতো বসন্তের প্রথম দিনে। বসন্তকালে প্রকৃতির নতুন করে জেগে ওঠাকেই তারা নতুন বছরের শুরু বলে চিহ্নিত করত। তখন চাঁদ দেখেই বছর গণনা করা হতো। যে দিন বসন্তের প্রথম চাঁদ উঠত, শুরু হতো বর্ষবরণ উৎসব, চলত টানা ১১ দিন। এই ১১ দিনের আবার আলাদা আলাদা তাৎপর্যও ছিল। ব্যাবিলনীয় সভ্যতার পর জাঁকজমক করে নববর্ষ পালন শুরু করে রোমানরা। প্রথম সম্রাট রোমুলাসই ৭৩৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে রোমান ক্যালেন্ডার চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। অবশ্য এই ক্যালেন্ডারও রোমানরা চাঁদ দেখেই বানিয়েছিলেন। আর সেই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নববর্ষ ছিল ১ মার্চ। সেই ক্যালেন্ডারে মাস ছিল মাত্র ১০টা। পরে সম্রাট নুমা পন্টিলাস জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারিকে ক্যালেন্ডারে যোগ করেন। সমস্যা ছিল আরো, রোমানদের ক্যালেন্ডারে তারিখও ছিল না। ধীরে ধীরে চাঁদের বেড়ে ওঠার ছবি দিয়ে তারা মাসের বিভিন্ন সময় চিহ্নিত করত।
সম্রাট জুলিয়াস সিজার এই ক্যালেন্ডারের পরিবর্তন ঘটান। তিনি ক্যালেন্ডস, ইডেস, নুনেসের ঝামেলা শেষ করে বসিয়ে দেন তারিখ। ফলে বছরে মোট ৩৫৫ দিন হয়। যেহেতু চাঁদের হিসাবে প্রতি মাসে দিন হয় সাড়ে ২৯। আর তাই চাঁদের হিসাব করায় তাদের বছরে ১০ দিন কম থাকত। এইভাবে বছর হিসাবের ফলে চাষিরা সমস্যায় পড়ে যায়। সম্রাট সিজার চাঁদের হিসাব না করে, সূর্য দিয়ে হিসাব করে বছরকে ৩৬৫ দিনে এনে এই সমস্যার সমাধান করেন। অনেকে বলেন, সেই সময়ে সূর্য দেখে প্রথমে ৩৬৫ দিনের নয়, ৪৪৫ দিনের ক্যালেন্ডার বানিয়েছিলেন! রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার লিপইয়ার বছরেরও প্রচলন করেন। জুলিয়াস সিজার আলেকজান্দ্রিয়া থেকে গ্রিক জ্যোতির্বিদ মোসাজিনিসকে নিয়ে আসেন ক্যালেন্ডার সংস্কারের জন্য। মোসাজিনিস দেখতে পান পৃথিবী সূর্যের চার দিকে প্রদক্ষিণ করতে সময় নেয় ৩৬৫ দিনে ৬ ঘণ্টা। ৩৬৫ দিন বছর হিসাব করা হলে এবং প্রতি চতুর্থ বছরে ৩৬৬ দিনে বছর হিসাব করলে হিসাবের কোনো গরমিল হয় না। আর তাই মোসাজিনিস অতিরিক্ত এক দিন যুক্ত করে এ বছরটির নাম করেন ‘লিপইয়ার’।
গ্রেট ব্রিটেনে এই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার প্রচলিত হয় ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দে। আর এই ক্যালেন্ডার আমাদের দেশে নিয়ে আসে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে।
বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে বর্তমানে চলছে এক নিদারুণ মন্দা। এ সময়ের সাথে অতীতের কোনো মিল নেই। যে মূল্যবোধগুলো রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখে সেখানে আচড় লেগেছে। অবক্ষয় সবখানেই। দেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ উপেক্ষিত। ভোটের অধিকারের জন্য এখনো রাজপথে স্লোগান দিতে হয়। অর্থনৈতিক বঞ্চনা থেকে মুক্তি মেলেনি। আজো জনগণের মৌলিক অধিকার প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে। দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতাকে সীমিত করে দিয়েছে। ইনসাফ ও সাম্য অধরাই রয়ে গেছে। বিগত বছরে অনেকগুলো ঘটনা দেশে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করে। ফেনীর নুসরাত রাফি হত্যা কিংবা বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার হত্যাকাণ্ড জনমানসে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে ছাত্রদের নির্বাচিত প্রতিনিধিকে বারবার রক্তাক্ত করা হয়েছে। পেঁয়াজের মূল্য বেড়েছে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বিগত বছরে ছিল ভয়াবহ। এককথায় খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক সমস্যাগুলো আজো নিশ্চিত হয়নি সর্বস্তরে।
মানুষে মানুষে ব্যবধান বেড়েছে বহুগুণ। অথচ এসব মৌলিক বিষয়ে বঞ্চনা থেকেই শুরু হয়েছিল আমাদের মুক্তি সংগ্রাম। নতুন বছরে আমাদের কামনা এই ব্যবধান ঘুচে যাক। শুরু হোক নতুন অধ্যায়। নতুন পথচলা। যেখানে অর্থনৈতিক বঞ্চনা যেমন থাকবে না ঠিক তেমনি প্রয়োজন হবে না গণতন্ত্রের জন্য কোনো লড়াই সংগ্রামের। বিদ্যাপীঠে শিক্ষার জন্য পাঠিয়ে লাশ হাতে পাবে না কোনো পিতা-মাতা। সমাজে থাকবে ইনসাফ সাম্য ও সুবিচার। বিভেদের রাজনীতির পরিবর্তে ঐক্য গড়ে উঠবে সব দল মত ও পথের মানুষের মধ্যে। দেশপ্রেমই হবে যার মূলমন্ত্র। নতুন বছরে হোক সেই প্রত্যয়, সেই আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন।