লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মানুষের সমাগমে বিপুল উৎসাহ, উদ্দীপনা ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার ঐতিহ্যবাহী পাঁচকমলাপুর দারুল উলুম হাফেজিয়া কওমিয়া মাদ্রাসার ১৩তম ঐতিহাসিক তাফসিরুল কোরআন মাহফিল সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। মহান বিজয় দিবসের দিন মাদ্রাসার পাশের বিশাল মাঠে অনুষ্ঠিত এ মাহফিলের মূল আকর্ষণই ছিলেন প্রধান বক্তা শায়খ মিজানুর রহমান আজহারী।
চুয়াডাঙ্গার কৃতী সন্তান বিশিষ্ট সমাজসেবক আলহাজ্ব সাহিদুজ্জামান টরিকের আয়োজনে ঐতিহাসিক তাফসিরুল এ কোরআন মাহফিলে শরিক হতে গতকাল সকাল থেকেই দূর-দূরান্ত থেকে মুসল্লিরা আসতে থাকেন। বাস-ট্রাক, মাইক্রো-মিনিবাস, সিএনজি-অটো, মোটরসাইকেলসহ নানা ধরনের ছোট-বড় যানবাহনযোগে মাহফিলে উপস্থিত হয়ে আলোচনা শোনেন কয়েক লাখ মানুষ। গতকাল দুপুরের পরপরই সড়কগুলোতে প্রচুর যানজটের সৃষ্টি হলেও ধর্মপ্রাণ মানুষেরা সেসব উপেক্ষা করেই পৌঁছান মাহফিলস্থলে। আয়োজকদের পক্ষ থেকে বিশালাকার প্যান্ডেলের প্রস্তুত রাখা হলেও মাঠ ছাপিয়ে দর্শক শ্রোতাদের জায়গা নিতে হয় আশপাশের সড়ক ও খালি জায়গায়।
বিকেল চারটা নাগাদ দেশের প্রায় ৩০ জেলা থেকে আগত ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের অংশগ্রহণে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় মাহফিল-প্যান্ডেল। তবে মাহফিলের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় মাগরিবের নামাজের পর। লাখ লাখ মানুষের অংশগ্রহণে প্যান্ডেলই আদায় করা হয় নামাজ ।
মাহফিলে পাঁচকমলাপুর দারুল উলুম হাফেজিয়া কওমিয়া মাদ্রাসার মুহতামিম হযরত মাওলানা আব্দুল হামিদ সভাপতির বক্তব্য দেন। এরপর বিশেষ বক্তা হিসেবে তাফসির পেশ করেন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, মুফাচ্ছিরে কোরআন হযরত মাওলানা মুফতি আলী আকবর। বেশ কিছু সময় তিনি কোরআন ও হাদিস থেকে বর্ণনা উপস্থাপন করে বক্তব্য দেন। রাত ৯টা নাগাদ মাহফিল ময়দানে এসে হাজির হন প্রধান বক্তা বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও আলোচিত বক্তা, বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলার ও কোরআন গবেষক শায়খ মিজানুর রহমান আজহারী। তাকে কাছ থেকে একনজর দেখতে খানিকটা উত্তাল হয়ে ওঠে মাহফিলে উপস্থিত ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা।
তবে শায়খ মিজানুর রহমান আজহারী মঞ্চে উঠে উপস্থিত সবার উদ্দেশে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে বয়ান শুরু করলে মুহূর্তেই পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে। তাঁর জন্য অধীর আগ্রহে থাকা মানুষেরা নিশ্চুপ হয়ে তার কথাই বুদ হয়ে যান। টানা ১ ঘণ্টা ৫৬ মিনিট ধরে পবিত্র কোরআন ও হাদিস থেকে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন তিনি। এর মধ্যে অন্যতম ছিল নারীর মর্যাদা, মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর ওপর কোরআন নাজিল, ইসলামের দাওয়াত ও মহান বিজয় দিবস। তবে এসবের মধ্যে তার আলোচ্য বিষয়ের মূল তাৎপর্য ঘিরে ছিলে ‘সুরা আদ্ দোহা’।
এর আগে মাহফিলের প্রধান অতিথি মাদ্রাসার পরিচালক, বাংলাদেশ বিজনেস চেম্বার অব সিঙ্গাপুরের প্রেসিডেন্ট ও সাহিদ গ্রুপের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব সাহিদুজ্জামান টরিক তাকে মঞ্চে নিয়ে এসে উপস্থিত সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন এবং উপস্থিতির উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন। এরপর আইনশৃঙ্খলা সমুন্নত রাখতে সবার সহযোগিতা চেয়ে বক্তব্য দেন পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার টোটন, দৈনিক সময়ের সমীকরণ-এর সম্পাদক ও প্রকাশক মো. শরীফুজ্জামান শরীফ, চুয়াডাঙ্গা পৌর মেয়র ওবাইদুর রহমান চৌধুরী জিপু, মাহফিলে দেশের বিভিন্ন শহর, গ্রাম, পাড়া, মহল্লা থেকে আগত লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লি, নারী-পুরুষসহ অন্তত সাড়ে পাঁচ লাখ জনতার উপস্থিতি চোখে পড়ে। দেরিতে আসায় মাহফিল ময়দানে জায়গা না পেয়ে যেখানে-সেখানে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রধান বক্তার বক্তব্য উপভোগ করেন অনেকেই।
এ ছাড়া মাঠের বিভিন্ন প্রান্তে ও আগত মহিলাদের জন্য প্রজেক্টরের মাধ্যমে সাদা পর্দায় মাহফিল পরিবেশন করা হয়। মাহফিলের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সার্বক্ষণিক দায়িত্বে ছিলেন পুলিশ, র্যাব, আনসার, গ্রাম পুলিশসহ স্থানীয় কয়েক শ’ স্বেচ্ছাসেবক। প্রধান বক্তা শায়খ মিজানুর রহমান আজহারীর বক্তব্য রেকর্ড করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে মঞ্চের সামনে ক্যামেরা নিয়ে ভিড় করেন শতাধিক ইউটিউবার ও আইপি টিভিসহ গণমাধ্যমকর্মীরা।
মাহফিলের আলোচনা শেষে মোনাজাতের আগমুহূর্তে পবিত্র কোরআনকে ভালোবেসে ও ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে উপস্থিত লাখ লাখ মানুষের সঙ্গে পবিত্র কালেমা পড়ে রনি কুমার দাস নামের এক হিন্দু যুবক নিজ ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। শায়খ মিজানুর রহমান আজহারী তাকে পবিত্র কালেমা পাঠ করান। স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হওয়া ওই যুবক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর তার নাম রাখা হয়েছে আব্দুর রহমান। তার বাড়ি চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার সরোজগঞ্জে। তিনি চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজের স্নাতক শ্রেণির দর্শন বিভাগের ছাত্র।