রনিকুল ইসলাম ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে অর্থনীতি বিভাগে স্নাতকে (সম্মান) ভর্তি হয়েছিলেন। ক্লাস শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে। স্বাভাবিকভাবে চললে এখন তাঁর ষষ্ঠ সেমিস্টারে (ছয় মাসে একটি সেমিস্টার), অর্থাৎ তৃতীয় বর্ষের শেষ পর্যায়ে থাকার কথা। কিন্তু এখন চতুর্থ সেমিস্টার পরীক্ষা শেষ হয়েছে মাত্র। ফল প্রকাশিত হয়নি। প্রায় এক বছর সেশনজট আছে তাঁদের।
এ রকম আরও কয়েকটি বিভাগে এক থেকে দেড় বছর পর্যন্ত সেশনজট লেগে আছে ময়মনসিংহের ত্রিশালে অবস্থিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। আবাসন-সংকটের কারণে মফস্বল এলাকায় অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের মেসে থাকা নিয়েও হচ্ছে নানা সমস্যা। আছে পরিবহনেরও সংকট।
এ ছাড়া আইন ভঙ্গ করে ফেল করা কয়েকজন শিক্ষার্থীকে প্রায় দুই বছর পর অন্য বিভাগে ভর্তি করানো, পরীক্ষা না নিয়েও শিক্ষার্থীদের মনগড়া নম্বর দেওয়া, শিক্ষক নিয়োগে একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাধান্য দেওয়াসহ প্রশাসনিক অনিয়মের অনেক অভিযোগ আছে।
ময়মনসিংহ শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে ত্রিশালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত এলাকায় ২০০৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে ক্লাস শুরু হয় ২০০৭ সালে। বর্তমানে ২৩টি বিভাগে পড়ানো হয়। দেশের বিভিন্ন এলাকার সাত হাজারের বেশি শিক্ষার্থী এখানে পড়ছেন।
সেশনজট ও আবাসন সমস্যা
কয়েকজন শিক্ষক ও বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অর্থনীতি, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই), চারুকলা, সংগীতসহ কয়েকটি বিভাগে সেশনজটের মাত্রা বেশি। চারুকলা বিভাগে ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া একজন ছাত্রী জানালেন, তাঁর প্রথম বর্ষে ক্লাস শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু গত অক্টোবরে কেবল চার বছরের স্নাতক (সম্মান) চূড়ান্ত পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এখনো ফল প্রকাশ করা হয়নি। অর্থাৎ দেড় বছরের বেশি সেশনজটে পড়তে হয়েছে তাঁকে।
২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র সাগর বিশ্বাস বললেন, গড়ে তাঁদের ১০-১১ মাসের সেশনজট আছে।
সেশনজটের কারণ সম্পর্কে অর্থনীতি বিভাগের ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান তানজিল হোসেন বলেন,উত্তরপত্র মূল্যায়নের পর সেটার দ্বিতীয় পর্যায়ের পরীক্ষক নিযুক্ত করা হয়অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। সেখান থেকে উত্তরপত্র পেতে দেরি হয়। আবার তাঁদের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরে জনবল-সংকট এবং তাঁদের বিভাগে শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে।
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে অগ্নিবীণা ও দোলনচাঁপা নামে দুটি আবাসিক হল আছে। একটিতে ছাত্র ও আরেকটিতে ছাত্রীরা থাকেন। দুই হলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা চার শর মতো। বাকিদের অধিকাংশই থাকেন আশপাশে গড়ে ওঠা মেসে। অনেকে আবার ময়মনসিংহ শহরেও থাকেন। কিন্তু পর্যাপ্ত বাস না থাকায় তাঁদের যাতায়াতে দুর্ভোগে পড়তে হয়। শিক্ষার্থীরা জানালেন, মেসে থাকতে তাঁদের নিরাপত্তাজনিত সমস্যাও আছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য এ এইচ এম মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, সেশনজট নিরসনের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে অনেক বিভাগে এই সমস্যা কেটেছে। আর আবাসন-সংকট কাটাতে শিগগিরই বহুতলবিশিষ্ট দুটি আবাসিক হল চালু হবে।
রেজিস্ট্রারকে শিক্ষক বানানোর তোড়জোড়
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার হুমায়ুন কবীর এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হতে চান। এ জন্য মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে চারটি প্রথম শ্রেণি থাকা এবং কমপক্ষে এক বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এই দুটির কোনোটাই নেই হুমায়ুন কবীরের। এখন নিয়ম পরিবর্তন করে যে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, তাতে হুমায়ুন কবীরের শিক্ষক হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার স্থলে অথবা দিয়ে বলা হয়েছে, পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা অথবা স্বীকৃত গবেষণা প্রতিষ্ঠানে তিন বছরের গবেষণার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। পিএইচডিধারী হুমায়ুন কবীরের গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজের অভিজ্ঞতা আছে। এখন শিক্ষাজীবনে চারটি প্রথম শ্রেণি না থাকা হুমায়ুন কবীরের শিক্ষক হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
অবশ্য উপাচার্য মনে করেন, হুমায়ুন কবীর শিক্ষক হওয়ার যোগ্য।
নিয়মভঙ্গ ও রাবিপ্রীতি
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন আবু নঈম আবদুল্লাহ। কিন্তু তিনি বিভাগের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষায় একাধিকার ফেল করেন। দুই বছর চলে যাওয়ার পর ২০১৮ সালে এই ছাত্রকে অনিয়ম করে ফোকলোর বিভাগে আবার প্রথম বর্ষে ভর্তির সুযোগ দেওয়া হয়, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনবিরোধী। এ নিয়ে ফোকলোর বিভাগের শিক্ষকেরা সভা করে প্রশ্ন তুললেও পরে মেনে নিতে বাধ্য হন। অভিযোগ আছে, ওই ছাত্রকে রাজনৈতিক বিবেচনায় এই সুযোগ দেওয়া হয়েছে। একইভাবে আরও অন্তত তিনজন ছাত্রকে বিভাগ পরিবর্তনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। উপাচার্য বললেন, মানবিক কারণে এটি করা হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, বর্তমান উপাচার্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষক হওয়ায় শিক্ষক নিয়োগ কমিটিতে বিশেষজ্ঞ নিয়োগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রাধান্য দিচ্ছেন। যাঁরা নিয়োগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। শিক্ষক নিয়োগেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা বেশি সুযোগ পাচ্ছেন।
বর্তমান উপাচার্যের আমলে সর্বশেষ ৮ জনসহ মোট ৫৬ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ আটজন বাদে বাকি ৪৮ জনের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তাঁদের ১৭ জনই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা।
উপাচার্য এ এইচ এম মোস্তাফিজুর রহমান দাবি করেন, এসব নিয়োগ মেধার ভিত্তিতেই হচ্ছে। আর তিনি নিজে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন চাকরি করায় সেখানকার ভালো বিশেষজ্ঞদের মেধাকে কাজে লাগাচ্ছেন।
এ ছাড়া হিসাববিজ্ঞান ও তথ্যপদ্ধতি বিভাগের শিক্ষার্থীরা উপাচার্যকে লিখিতভাবে জানিয়েছেন, একজন শিক্ষক তাঁদের একটি কোর্সের মিডটার্ম পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট ও উপস্থাপনা (প্রেজেন্টেশন) ছাড়াই মনগড়া নম্বর দিয়েছেন। এতে যাঁরা পরীক্ষায় ভালো করতেন বলে মনে করছেন, তাঁদের মধ্যে বেশি ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানায়, এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অবশ্য এই কমিটির কার্যক্রম স্থগিত আছে।
তুলনামূলক নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয় সমস্যার বৃত্ত থেকে বের হতে পারছে না। ২০১৭ সালে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মোহীত উল আলমের সময় এবং তাঁর চলে যাওয়ার পরও নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে অস্থিরতা ছিল। এরপর ২০১৭ সালের নভেম্বরে বর্তমান উপাচার্যকে চার বছরের জন্য নিয়োগ দেয় সরকার। কিন্তু এখনো নানা সমস্যা রয়ে গেছে। নতুন কিছু অভিযোগও সামনে এসেছে। সূত্র: প্রথম আলো