সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপ কর্মসূচির আওতায় গতকাল সোমবার পর্যন্ত সারাদেশে ১৭ লাখ ৯ হাজার ৫৮০ জন প্রতিবন্ধী শনাক্ত হয়েছেন। ময়মনসিংহে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা নির্ধারণ হয়েছে ৬১ হাজার ১৭৯ জন। অর্থাৎ, ময়মনসিংহে ৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ প্রতিন্ধী পাওয়া গেছে।
এবছর প্রতিবন্ধীপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে কুমিল্লা জেলা। আর সবচেয়ে কম প্রতিবন্ধী পাওয়া গেছে বান্দরবান জেলায়। বান্দরবানের পাশাপাশি দুই পার্বত্য জেলা রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা কম বলে জরিপ পর্যালোচনায় দেখা গেছে।
এদিকে, বিভাগ হিসেবে রাজধানী ঢাকা এবারও শীর্ষে অবস্থান করছে। তবে সর্বনিম্ন প্রতিবন্ধীপ্রবণ এলাকার বিন্যাসে এবার পরিবর্তন এসেছে। গত বছর সর্বনিম্ন প্রতিবন্ধীপ্রবণ বিভাগের তালিকায় ছিল বরিশাল। এবার সেখানে অবস্থান নিয়েছে সিলেট বিভাগ। প্রতিবন্ধিতার ১২টি ক্যাটাগরির মধ্যে সর্বোচ্চ শারীরিক প্রতিবন্ধী। আর সর্বনিম্ন ক্যাটাগরিতে রয়েছে ডাউন সিনড্রোম প্রতিবন্ধী। মোট জনগোষ্ঠীর ১ শতাংশের কিছু বেশি প্রতিবন্ধিতার শিকার বলে জরিপে উঠে এসেছে। তবে এলাকাভেদে প্রতিবন্ধিতার সংখ্যা কমবেশি হওয়ার কারণ সম্পর্কে কোনো ধারণা দিতে পারেননি এর সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে প্রতিবন্ধিতা জরিপ কর্মসূচি প্রকল্পের পরিচালক ডা. আশরাফী আহমেদ বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিবন্ধিত করতে গিয়ে তাদের সব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। বিভিন্ন ক্যাটাগরি ও এলাকাভিত্তিক পর্যালোচনা করে প্রাপ্ত তথ্যই কেবল সংরক্ষণ করা হয়েছে। কী কারণে এলাকাভিত্তিক সংখ্যাগত তারতম্য রয়েছে, তা তাদের জানা নেই। বিষয়টি জানতে হলে এ নিয়ে গবেষণা করতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে তিনি নিজেও সেটি চান। তবে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে।
জরিপ কর্মসূচির সার্বিক বিষয় তুলে ধরে পরিচালক বলেন, পাইলট প্রকল্প হিসেবে ২০১২ সালে ১২ জেলা ও দুটি ইউসিডিতে জরিপকাজ শুরু হয়। এরপর ২০১২-১৩ অর্থবছরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে জরিপ পরিচালনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের জুন থেকে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু হয়। এর পর থেকে এ পর্যন্ত ১৭ লাখের কিছু বেশি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হয়েছে। আগামী ২০২১ সাল পর্যন্ত এ কর্মসূচি চলবে। পরে আর্থিক বরাদ্দ দেওয়া হলে কর্মসূচির মেয়াদও বাড়বে।
এ অবস্থায় আজ মঙ্গলবার পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস’। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘অভিগম্য আগামীর পথে’। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রতিবন্ধিতা জরিপ কর্মসূচি সূত্রে জানা যায়, দেশে এ পর্যন্ত ১৭ লাখ ৯ হাজার ৫৮০ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছে। এতে সর্বোচ্চ প্রতিবন্ধীপ্রবণ এলাকা হিসেবে কুমিল্লা জেলাকে শনাক্ত করা হয়েছে। এই জেলায় প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ৬৮ হাজার ৭৯৭ জন, যা মোট সংখ্যার ৪ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। এরপর পর্যায়ক্রমে ময়মনসিংহে ৬১ হাজার ১৭৯ জন, চট্টগ্রামে ৬০ হাজার ৭১৬, টাঙ্গাইলে ৪৮ হাজার ৫৩৮, রংপুরে ৪৭ হাজার ৬২৭, ঢাকায় ৪৫ হাজার ১২২, রাজশাহীতে ৪১ হাজার ৪১২, বগুড়ায় ৪১ হাজার ১০৩, দিনাজপুরে ৩৯ হাজার ৮৭৬ ও সিলেটে ৩৬ হাজার ৬৮৮ জন প্রতিবন্ধী শনাক্ত হয়েছে। এ হিসাব অনুযায়ী, ময়মনসিংহে ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৩ দশমিক শূন্য ৫৫, টাঙ্গাইলে ২ দশমিক ৮৩, রংপুরে ২ দশমিক ৭৮, ঢাকায় ২ দশমিক ৬৩, রাজশাহীতে ২ দশমিক ৪২, বগুড়ায় ২ দশমিক ৪, দিনাজপুরে ২ দশমিক ৩৩ ও সিলেটে ২ দশমিক ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী রয়েছে।
সবচেয়ে কমসংখ্যক প্রতিবন্ধী পাওয়া গেছে বান্দরবান জেলায়। এ জেলায় পাঁচ হাজার ৭২৬ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি তালিকাভুক্ত হয়েছে, যা মোট সংখ্যার শূন্য দশমিক ৩৩ শতাংশ। পার্বত্য অন্য দুই জেলা রাঙামাটিতে আট হাজার ও খাগড়াছড়িতে ৯ হাজার ৫২২ জন প্রতিবন্ধীর সন্ধান মিলেছে, যা মোট সংখ্যার শূন্য দশমিক ৪৬ ও শূন্য দশমিক ৫৫ শতাংশ।
এ ছাড়া বিভাগ হিসেবে সর্বোচ্চ ঢাকায় ১৯ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী রয়েছে। এরপর পর্যায়ক্রমে চট্টগ্রামে ১৮ দশমিক ৫১ শতাংশ, রাজশাহীতে ১৪ দশমিক ৪১, খুলনায় ১৪ দশমিক ২৫, রংপুরে ১৩ দশমিক ৫৬, ময়মনসিংহে ৭ দশমিক ৭৪, বরিশালে ৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন সিলেটে ৬ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি পাওয়া গেছে।
প্রতিবন্ধীরা নানা বঞ্চনার শিকার :দেশি ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় ঘাটতি থাকায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা নানা বঞ্চনা ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩-এর ৩১ ও ৩৬ ধারা অনুযায়ী তাদের পরিচয় ও উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়নি। শুরুতেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা আইনের এ দুটি ধারা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন। এ ধারা বাতিলের দাবিতে তারা আন্দোলনেও নেমেছিলেন। এর পর গত বছর আইনের ৩১ ধারার ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক গাজী মোহাম্মদ নুরুল কবির সমকালকে বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে। এখনও পরিচয়পত্র দেওয়ার কাজ চলছে। অন্য ধারাটিও নিষ্পত্তির পথে রয়েছে। কারণ, সরকার প্রতিবন্ধীদের অধিকার ও সুরক্ষার বিষয়ে অত্যন্ত আন্তরিক এবং তাদের সব বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়।
শিক্ষা ও চিকিৎসা অধিকারে পিছিয়ে :প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ও অধিকার আইন এবং শিক্ষানীতিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শিক্ষার সর্বস্তরে অংশগ্রহণের ঘোষণা দেওয়া হলেও তা আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, সরকারি বিদ্যালয়ে গড়ে ২১ ও বেসরকারি বিদ্যালয়ে একজন করে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী ভর্তি আছে। বিদ্যালয়প্রতি গড়ে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের হার ৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ। অটিস্টিক একাডেমি স্থাপন প্রকল্প চালুর পর গত বছর নভেম্বরে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের ৫০ শিক্ষক রাজধানীর ৮৭ বিদ্যালয়ে জরিপ চালিয়ে এ তথ্য পান। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় পূর্বাচলে ৩ দশমিক ৩১ একর জমির ওপর অটিস্টিক একাডেমি প্রতিষ্ঠার কাজ এগিয়ে চলছে। চলতি বছর তা শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। অটিস্টিক একাডেমি প্রতিষ্ঠা প্রকল্পের পরিচালক সালমা বেগম জানান, ওই একাডেমি প্রতিষ্ঠার কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এটি প্রতিষ্ঠিত হলে প্রতিবন্ধী শিশুরা শিক্ষা ও চিকিৎসা সুবিধা পাবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও অটিজমবিষয়ক জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত সমকালকে বলেন, প্রতিবন্ধী, বিশেষ করে অটিস্টিক শিশুরা শিক্ষার দিক থেকে একটু পিছিয়ে থাকে। কিন্তু শুরুতেই স্বাভাবিক শিশুদের সঙ্গে মিশতে দিলে তাদের ভাষাগত দক্ষতা ও অস্বাভাবিকতা কিছুটা সংশোধন হবে। সুতরাং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক শিশুদের সঙ্গে প্রতিবন্ধীদের বেশি করে একীভূত করার উদ্যোগ নিতে হবে।
চিকিৎসা নিতে গিয়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। বিএসএমএমইউর ইপনা সেন্টার ছাড়া সরকারিভাবে তাদের জন্য পৃথক কোনো চিকিৎসাকেন্দ্র নেই। এমনকি চিকিৎসকদের তাদের চিকিৎসা দেওয়ার বিষয়ে কোনো প্রশিক্ষণ নেই। স্বল্প পরিসরে কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তাদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ জানান, সাধারণ মানুষের পাশাপাশি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও সরকারি হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যে চিকিৎসা সুবিধা পাচ্ছেন। এ ছাড়া সাধারণ রোগীদের মতো তাদের লাইনে দাঁড়িয়ে সেবা নিতে হয় না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে সারাদেশের সরকারি হাসপাতালে এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা দেওয়া আছে। সুতরাং তাদের ভোগান্তির বিষয়টি তত বেশি হওয়ার কথা নয়। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সুবিধার জন্য কয়েকটি হাসপাতালে স্বল্প পরিসরে স্পিচথেরাপি এবং অ্যাকুপেশনাল থেরাপির ব্যবস্থা রয়েছে। ধাপে ধাপে তা বাড়ানো হবে।
কর্মসূচি :সংশ্নিষ্টরা জানান, আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসের অনুষ্ঠানে প্রতিবছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি হিসেবে দিবসের মূল অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন। কিন্তু জলবায়ু সম্মেলনে যোগদানের কারণে তিনি বর্তমানে স্পেনে রয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার পর ৫ ডিসেম্বর দিবসের মূল অনুষ্ঠান করা হবে। রাজধানীর মিরপুরে প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনে ওই দিন তিনি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। তবে অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দিবসটি উপলক্ষে আজ নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে।