আপনাকে যদি এখন জিজ্ঞাসা করা হয়, ক্লাব ফুটবলের ইতিহাসে সেরা রাইভালরিটা কার, আপনি যদি ফুটবলের ব্যাপারে সামান্য খোজ খবর রাখেন, আপনি বলবেন, রিয়াল মাদ্রিদ এবং বার্সেলোনা। এটি এমন এক রাইভালরি যা শুধু ফুটবলে আটকে থাকে না, স্পেনের শাসনতন্ত্র পর্যন্ত গড়ায়। তবে স্পেনের শাসনতন্ত্রে এই দুই ক্লাবের প্রভাব নিয়ে আজ লিখতে বসিনি, বসেছি একটা ট্রান্সফারের গল্প বলতে, ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত ট্রান্সফার, যেটা দেখেছিলো লুইস ফিগো কে বার্সেলোনা থেকে রিয়ালে যেতে, কিউলদের আজীবন চক্ষুশূল হতে।
পর্তুগীজ উইঙ্গার লুইস ফিগো বার্সেলোনায় যোগ দেন ১৯৯৫ সালে, যোগ দেওয়ার পর সেখানে জেতেন দুটি লীগ, দুটি কোপা দেল রে, ১টি স্প্যানিশ সুপার কাপ, ১টি অধুনা বিলুপ্ত কাপ ইউয়েফা কাপ উইনার্স কাপ, ১টি ইউয়েফা সুপার কাপ। বার্সেলোনা সমর্থকদের নয়নের মণি ছিলেন তিনি, ছিলেন বার্সেলোনার প্রধান তারকা, ছিলেন অন্যতম অধিনায়কও, ক্লাব ছাড়ার কোন কারণই ছিলো না তার। ঝামেলাটা বাধলো রিয়াল মাদ্রিদের প্রেসিডেন্ট ইলেকশনের সময়।
আগে একবার প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশনে হারা ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ আবারও মাঠে নামলেন, তার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন রিয়ালের ৩২ বছরের চ্যাম্পিয়নস লীগ খরা কাটানো প্রেসিডেন্ট লরেঞ্জো সাঞ্জ। স্বাভাবিকভাবেই, জয়ের পাল্লাটা সাঞ্জের দিকেই ভারী ছিলো। তাই, বিশাল এক ঘোষণা দিয়ে ফেললেন পেরেজ, ইলেকশনে জিতলে ফিগো কে রিয়াল মাদ্রিদে নিয়ে আসবেন তিনি। আর যদি না পারেন তবে রিয়াল মাদ্রিদের ৮৩,৯৬৭ জন সদস্যকে পুরো সিজন ফ্রি তে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে খেলা দেখতে দেবেন তিনি।
আর এদিকে, ফিগোর সাথে চুক্তি করেন পেরেজ, যে যদি সে ইলেকশনে জেতে, তবে রিয়ালে যাবেন ফিগো আর এই চুক্তির বিনিময়ে ১.৭ মিলিয়ন পাউন্ড ফিগোকে দেন পেরেজ, যদি পেরেজ ইলেকশনে হেরেও যান, তবুও এই টাকা রেখে দিতে পারবেন ফিগো। তবে যদি পেরেজ জিতে যান এবং ফিগো রিয়ালে না যান, তবে ফিগোকে উলটো পেরেজকে দিতে হতো ২২ মিলিয়ন পাউন্ড! ফিগো এবং তার এজেন্ট এটিকে দেখেন সহজ উপায়ে বেশ কিছু অর্থ আয়ের, যদিও বাস্তবে এটি ছিলো তার হঠকারিতা এবং বার্সেলোনার প্রতি তার আনুগত্যের অভাব। এছাড়াও তারা ভাবেন, পেরেজের এই প্রস্তাব ব্যবহার করে তারা বার্সেলোনার কাছে থেকে ফিগোর বেতন বাড়িয়ে নেবে, যা স্পষ্ট ইঙ্গিত করে, ফিগো আসলে আনুগত্যের চেয়ে টাকাকেই বেশি মূল্য দিতেন।
পেরেজের সাথে এই চুক্তির কথা স্বাভাবিকভাবেই ফাঁস হয়ে যায় মিডিয়াতে, এবং স্বভাবতই এই চুক্তির কথা অস্বীকার করেন ফিগো। ৯ জুলাই, ২০০০ তারিখে তিনি কাতালান পত্রিকা স্পোর্ট এ বলেন, “আমি ফ্যানদের বিশ্বের সকল নিশ্চয়তার সাথে আশ্বস্ত করছি যে, লুইস ফিগো ২৪ জুলাই সিজনের শুরুতে ন্যু ক্যাম্পে থাকবেন” (সূত্র – মার্কা), যে কথার মান তিনি রক্ষা করতে পারেননি।
আসলে ফিগো এরকম কিছু বলতে বাধ্য হয়েছিলেন এই কারণে যে, তিনি তখনও একজন বার্সেলোনা খেলোয়াড় এবং ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ এখনও ইলেকশনে জয়লাভ করেননি। যার মানে, তার এখনও বার্সেলোনায় তার স্টার ইমেজ বজায় রাখার দরকার ছিলো। তাই তিনি চাইলেও, পেরেজের সাথে তার গোপন চুক্তির কথা স্বীকার করতে পারেননি।
অন্যদিকে, বার্সেলোনায়ও হচ্ছিলো প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশন, এবং সেখানে সম্ভাব্য জয়ী প্রার্থী গ্যাসপার্টের সাথে ফিগোর এজেন্ট হোসে ভেইগা যখন আলাপ করেন, কিন্তু যা ছিলো, গ্যাসপার্ট শুধু মাত্র ওয়াদা করতে পারেন যে, তিনি ফিগোর কন্ট্রাক্ট উন্নত করবেন। অন্যদিকে পেরেজের অফার ছিলো নগদ অর্থের বিনিময়ে, যা ফিগোর প্রলোভন বাড়িয়ে দেয় রিয়াল মাদ্রিদের প্রতি।
যখন রিয়ালের নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হয়, কয়েকশ ভোটের বিনিময়ে জয়ী ঘোষিত হন ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ, এবং চুক্তি মতে, ফিগো বলতে গেলে বাধ্য থাকেন রিয়ালে যোগ দিতে, কারণ তখনকার সময়ে তার পক্ষে এত বিশাল পরিমাণ টাকা পেরেজকে দেওয়া সম্ভব ছিলো না। তিনি গ্যাসপার্টকে অনুরোধ করলেও, গ্যাসপার্ট টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানান, তার কারণ ছিলো প্রধানত দুইটি, প্রথমত, ফিগো বার্সেলোনার প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত থাকলে কখনই পেরেজের সাথে সেই চুক্তি করতেন না। দ্বিতীয়ত, বার্সেলোনার ওই টাকা দেওয়ার মানে ছিলো, বার্সেলোনার টাকা দিলে রিয়ালের সদস্যরা বিনা মূল্যে খেলা দেখবেন, কারণ পেরেজ বলেছিলেন ফিগো না আসলে তাদের ফ্রি তে খেলা দেখতে দিবেন। এই দুই কারণেই সদ্য নির্বাচিত গ্যাসপার্ট কোন ভাবেই রাজি হন নি, এবং পেরেজ ইতোমধ্যেই লা লীগা কমিটির কাছে ফিগোর বাই আউট ক্লজ ৬২ মিলিয়ন ইউরো জমা দিয়ে দেন। এবং যেখানে ২৪ জুলাই সিজনের শুরুতে ন্যু ক্যাম্পে থাকার কথা ছিলো ফিগোর (তার নিজের কথা অনুযায়ী), সেখানে তাকে দেখা গেলো রিয়ালের ১০ নাম্বার জার্সি নিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখে ছবি তুলতে। এই সাইনিং ছিলো পেরেজের স্বপ্নের গ্যালাকটিকোস গড়ে তোলার প্রথম সাইনিং, গ্যালাকটিকোসদের নিয়ে পরে একদিন কথা হবে! আর ফিগোর সেই হাসিতে আপনি অনেক চেষ্টা করেও বিশ্বাসঘাতকতা বা ফেসে যাওয়ার বা অনুতাপের চিহ্ন পাবেন না, বরং তাতে ছিল আনন্দ, অর্থের? কি জানি!
এই ট্রান্সফারের পর থেকেই বার্সেলোনার সবচেয়ে ঘৃণিত খেলোয়াড়ে পরিণত হন লুইস ফিগো, এবং তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছোয় যখন তিনি ক্লাসিকো তে ন্যু ক্যাম্পে খেলতে নামেন। সেই সময় ন্যু ক্যাম্পের পরিবেশের জন্য একটা শব্দই যথার্থ – বিষাক্ত! স্টেডিয়ামের ভিতরে ফ্যানদের মুখে একটাই কথা, “ফিগো, মরো!”; “বিশ্বাসঘাতক!” স্টিভ ম্যাকমানান এর বই “এল ম্যাক্কা : ফোর ইয়ার্স উইথ রিয়াল মাদ্রিদ” এ বলেন, স্প্যানিশ টেলিভিশন চ্যানেল ক্যানাল প্লাস সেদিন স্টেডিয়ামে একটি সাউন্ড মিটার স্থাপন করে, যা প্রমাণ করে, ওইদিন ন্যু ক্যাম্পের স্টেডিয়ামের শব্দ ছিলো কাতালোনিয়ার যেকোন নাইট ক্লাবের সাধারণ শব্দের চেয়ে বেশী! ষাড়ের লড়াইয়ের হাজার হাজার সাদা রুমাল নাড়ানো হচ্ছিলো, যার মানে ছিলো, ফিগোকে হত্যা করা আবশ্যক! ফিগো মাঠে নামার সময় কানে আঙুল দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, তবে কাজ হয়নি। অবশ্য ফিগোর প্রতি তীব্র ক্ষোভের আরেকটি কারণ ছিলো, কিছুদিন আগেই ফিগো একটি ব্যাংকের বিজ্ঞাপনে অংশ নেন, যার মধ্যে তিনি বলেন, “পরিবর্তন সবসময়ই ভালো, যদি তা উন্নতির জন্য হয়”, এই বিজ্ঞাপন কিউলদের মনে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনে ঘি ঢালা ছাড়া আর কিছুই করে নি! (সূত্র – ব্লিচার রিপোর্ট)।
ফিল বলের বই “মরবো” অনুযায়ী, ফিগোর দিকে মাঠে মিসাইলের মত ছুড়ে দেওয়া হচ্ছিলো সিগারেটের গোড়া, পয়সা, মোবাইল ফোন, ইটের টুকরো, এমনকি সাইকেলের চেইনও! যদিও পরে এক সময় ফিগো বলেন, তিনি সেরকম পরিবেশই আশা করেছিলেন।
২০০২ এর ক্লাসিকোতে অবস্থা ছিলো আরও খারাপ, স্টেডিয়ামে ঢুকার সময় বাসের রাস্তার দুই পাশে ২৫ মিটার করে দূরত্ব রাখে পুলিশ, তবুও ইট, পাথরের বর্ষণ চলছিলো ফিগোদের বাসের উপর! খেলাটি গোলশূন্য ড্র হয়, এর মাঝে দ্বিতীয়ার্ধের মাঝপথে ১৬ মিনিট খেলা বন্ধ রাখতে হয়, কারণ, ফিগোর কর্নার নিতে প্রচুর অসুবিধা হচ্ছিলো। আর এই কর্নার নেওয়ার সময়ই ঘটে ফিগো কাহিনীর সবচেয়ে কুখ্যাত অধ্যায়, বার্সেলোনার গ্যালারি থেকে একটি শুকরের মাথা ছুড়ে দেয়া হয় ফিগোর দিকে!
শুয়োরের মাথাটি ছিল রক্তাক্ত, আর এটি দিয়ে প্রকাশ পায়, ঠিক কতখানি ঘৃণা করতে শুরু করেছিলো কিউলরা, তাদের এক সময়ের নয়নের মণিকে। কিছু সূত্রের মতে, ছোড়া হচ্ছিলো ছোরাও!
ফিগো এরপর রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে ২টি লীগ, ২টি কোপা দেল রে, একটি চ্যাম্পিয়নস লীগ, একটি সুপার কাপ ও একটি ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ জয় করেন। এছাড়াও রিয়ালে অবস্থানকালেই তিনি তার ক্যারিয়ারের প্রথম ও একমাত্র ব্যালন ডি অর ও ফিফা বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জেতেন, ব্যালন ২০০০ ও ফিফা বর্ষসেরা ২০০১ সালে।
এই ঘৃণা বেচে আছে এখনও, ২০১৫ চ্যাম্পিয়নস লীগ ফাইনালের পূর্বে ইউয়েফা দুই ফাইনালিস্ট বার্সা ও জুভেন্টাসের লিজেন্ডদের নিয়ে একটি ম্যাচ আয়োজন করে, সেখানে বার্সা দলে প্রথমে ইউয়েফা ফিগোকে রেখেছিলো, কিন্তু বার্সেলোনার অনুরোধে শেষ পর্যন্ত বাদ দিতে হয় তাকে! কতখানি ঘৃণা ভাবতে পারেন?
লেখাটি পড়ে হয়ত আপনার ধারণা জন্মাতে পারে, ফিগো বাধ্য হয়েছিলেন রিয়াল যোগ দিতে। আসলেই কি তাই? মনে হয় না। কেননা, যদি বার্সেলোনার প্রতি তার আনুগত্য থাকতো, তখন সে কোনভাবেই পেরেজের সাথে সেই চুক্তি করতেন না। কেননা, তিনি বার্সেলোনায় ছিলেন প্রধান তারকা, ছিলেন তাদের অতি আদরের অধিনায়কও!
ক্লাবের প্রতি অনুগত কোন খেলোয়াড় ক্লাবে এরকম অবস্থানে থাকার পরে অন্য ক্লাবের সাথে এমন চুক্তি করেন না, যেই চুক্তি তার ক্লাবের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়। এমনকি পরে এক সাক্ষাৎকারে লুইস ফিগো বলেন, বার্সেলোনায় তিনি তার কাজের জন্য কম স্বীকৃতি পাচ্ছিলেন, আর তিনি নাকি এই ট্রান্সফারের আগে বেশ কয়েকবার ভেবেছিলেন, তবে শেষ পর্যন্ত মাদ্রিদের লোকজন তাকে রিয়ালে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে রাজি করিয়ে ফেলে। তার মানে কি এই দাঁড়ায় না, তিনি ফেসে যাননি? বরং নিজের ইচ্ছা ছিল বলেই গিয়েছিলেন? এজন্যই বার্সেলোনার লুইস ফিগো একজন ঘৃণিত মানুষ, অথচ হয়ে থাকতে পারতেন ক্লাবের ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড়দের একজন।
এখন তাকে কাতালোনিয়ায় মনে রাখা হয় বিশ্বাসঘাতক হিসেবে, যাকে পরম আত্মীয় ভেবে জড়িয়ে ধরার পর তিনি পিঠে ছোরা চালিয়েছিলেন। তাই লুইস ফিগো বার্সেলোনা ইতিহাসের সেরাদের মাঝে ঠাঁই পান না, বরং বার্সেলোনার ইতিহাসে ঠাই পান একজন বিশ্বাসঘাতক হিসেবে, তাদের মীর জাফর হিসেবে!